Skip to main content

Full text of "Uponyas"

See other formats


বডেও 168৬ 
র্ু 
( উপন্যাস ) 


প্রবোধকুষার সাহ্যাল 


৬্নলীজ্ভ 





উজীষ্পাল্বভিলশ্শিৎু ০হ্কা্জ্পাভ্নী 
কলিকাতা | 


প্রকাশক 2 দিলীপকুমান বোস 
১০৩৪, কর্ণওয্ালিস স্রীট, কলিকাতা 


মডেল সক্কেত 


1দিতীয় সংস্রূণ *** বৈশাখ ১৩৪ হ 


মুলা-__ছহই টাক? চারি আনা 


“গুঞগ্তত্পেশশ” 
০৭।৭ হেণিক্বাটোলা লেন, কিকাাতা হইতে 
আীকিশ্োরীমোহন নন্দী কতক সুদ্রিত । 


 শলবৈশাখীর প্রবল ঝাড়বুষ্টির মধ্যে বাবাকে গাড়ী হইতে নামাইয়া 
ইবার জন্য আমি হাওড়া স্টেশনে গিয়া অপেক্ষা করিতেছিলাম। আমি 
ধার একমাত্র পুত্র, ভবিষ্যং জগিদারীর নিভুলি ও নিবন্শ স্বত্বাধিকারী, পিতৃ- 
। ঘোগের পর জমিদারীটা যথেচ্ছ বাবহার করিতে পারিব--এই সথখকল্পনায় 
তাঁমি প্রকাশ্যে চরিত্রবান ও পিতৃবাধ্য ছিলাম। 
মনে করিয়াছিলাম-_দূর হইতে পিতাকে দেখিয়া হাতের জলম্ক দিগারেটটা 
' এয়া দিব, কিন্তু তাহার আর প্রয়োজন রহিল না। যথাসময়ে পশ্চিমের 
১ আসিয়া ঈ্াড়াইল। কিন্ধু বাব| আসিলেন না। খানিকটা খোঙ্গ 
র্লাম। কিন্তু রূপনগরের জমীদার মহাশয় দ্বিতীয় শ্রেণী ভিন্ন ভ্রমণ করেন 
ইহা জাঁ য়াআমি আর বেশী পরিশ্রম করিলাম না। ধারে স্থম্থে সমস্ত 
খা ..র মুখের উপরেই আর একটা নেভিকাট্‌ ধরাইয়৷ মনে করিলাম, কোথাও 
কখান! বেঞ্চে বসিয়া ঝড়বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত কালবৈশাখীকে লইয়। এক্ট্রখানি 
ত্বকরা যাক। আজ এক মাস যাঁবৎ বৈশাখের প্রচণ্ড নৌতে ও রাত্রে 
নত” গলদঘর্ম হইয়া উঠিয়াছিলাম, কল্পনা ছিল পিতা আসিলে আগামী- 
নিকট কয়েক শত টাকা শোষণ করিয়া দাঞ্জিলিঙে গিয়া শ্লো-ভিউ- 
তত. এবং সন্ধ্যার দিকে ম্যাল্-এ গিয়া বাঙালী মেমদের আধুনিক ্টাইলের। 
করিয়া বেড়াইব, কিন্তু পিতা জীবিত থাকিয়াই যখন আমার কল্ননা' 
0..ভাঁবে ৭.র্থ করিলেন, তখন তিনি মরিলে হয়ত তাহার তালপুকুরে আমার 
- ইবার ঘটিটাও ডুবিবে না। 
কখানা লোহার বেঞ্চ একাকী আশ্রয় করিয়। বসিলাম। “বেকার জীবন 
£রিয়া শরীরে কিছু মেদ বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহার উপর গ্রীষ্মকাল এবং 
1২, উপরেও ধনাঢা পিতার গরম, সমস্তটা মিলিয়া কিছুকাল হইতে হাসফ্কাস 


১ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


করিতেছিলাম। এমন অবস্থায় এই অকাল বাদলের সজল হাওয়ায় বড়ই 
পুলকিত হইলাম । পকেটে কিছু টাক ছিল, একআধ জন বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে 
থাকিলে হাবড়া স্টেশনের ইহুদীর হোটেলে পদধূলি দিতাম । 
ঝড়ে, বৃষ্টিতে, মেঘের গর্জনে, দিশাহার! যাত্রীদের উচ্চবৌলে সমগ্র হাবড়া 
স্টেশনের চাবিধার ওলোট-পালট হইতেছিল। বুষ্টিধারার ঝালরের বাহিরে 
চারিদিক ধূসর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ঠিক এমনি সময়ে আমার পিছন দিক হইতে 
যে নাটকীয় ঘটনাটি ঘটিল, তাহা কালবৈশাখীর এই প্রবল বিপর্ময় ছাড়া আর 
কোনও অবস্থাতেই হয়ত সম্ভব হইত না। 
উপন্যাস রচন। করা আমার পেশ। নহে; কিন্তু যাহা ঘটিল, তাহা ঝড়ের 
মতো একটানে আমার আলস্যবিলাস জীবনকে মূল কেন্দ্র হইতে উৎপাটন করিয়! 
দুরে নিক্ষেপ করিয়া দিল। 
কবিত্ব করিবার জন্য সিগারেটটা! টানিতে টানিতে নিমীলিত দৃষ্টিতে বসিয়া" 
ছিলাম । জটল! পাকাইয়। যাত্রীর আনাগোনার দিকে একটুও লক্ষ্য ছিল না । সহসা 
ভীড়ের ভিতর হইতে নারীকণ্ঠের প্রশ্ন শুনিয়। সচকিত হইয়া চাহিলাম । 
নমস্কার । চিনতে পারেন? 
বিস্ময়ে হতবাক্‌ হইয়া এক তরুণীর দিকে মুখ তুলিলাম। আমার মাতা- 
ঠাকুরাণী আমাকে সতর্ক করিয়া বলিয়া! থাকেন, আইবুড়ো ছেলে একা-একা 
থাকিলে প্রেতিনী আসিয়া গ্রেপ্তার করে। সেই কথা সহসা মনে পড়িয়৷ একটু 
সজাগ ও সোজা হইয়া! বসিলাম। বলিলাম, কে আপনি? 
ওমা চিনতে পারলেন না? আমি সরোজিনী দেবীর মেয়ে, মৃন্ময়ী ।-_-বলিয়! 
আধুনিক সঙ্জায় সুসজ্জিতা সুন্দরী প্রেতিনীটি হাসিমুখে আমার দিকে চাহিল। 
বলিলাম, সরোজিনী দেবী কে? 
বেশ যা হোঁক, এই ক" বছরেই সব ভুলে গেলেন? অবশ্য আপনি তখন 
 ছেলেমানুষই ছিলেন, চোদ্দ পনেরো বছরের বেশি নয়। আপনার নাম ভঃ 
রাজেজ্জ? 


বড়ের সঙ্গেত 


মানলুম। 

প্রেতিনী কাহল, আপনার বাবার নাম ব্রজেনবাবু ত? 

বলিলাম, মিথ্যে নয় । 

আপনার মায়ের নাম স্থরসুন্দরী কিন! ? 

লোকে তাই জানে। 

সে কহিল, এত ব্ললুম, তবু আমাকে চিনতে পারলেন ন? আপনি 
ছোঁটবেল! কা'র গলা ধরাপরি ক'রে “শিবের গাছন” গাইতেন ? 

সবিম্ময়ে তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলাম। সে পুনরায় কহিল, 
মনে নেই আপনার মানবের আদেশে আপনার বাবা! আমাদের ঘর জালিয়ে 
উৎখাত করেছিলেন? 

চুপ করিয়া বৃহিলাম । 

ৃন্নয়ী হাসিমুখে আবার বলিল, সেই আমার বিধবা মা, যার ঘরে দু'বেলা 
আপনার জলযোগের বরাদ্দ ছিল। 

আমার ভিতরের জমীদার এইবার কথা কহিল। বলিলাম, হ্যা, এইবার 
সবই একটু একটু মনে পড়েছে । ঘর জালিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন, সে 
কথাটা কি ভেবে দেখেছ ? 

ই, আমার মায়ের নামে কলঙ্ক রটেছিল। 

শুধুই কি রটন1? নিজের কে আছি ইচ্ছ| করিয়াই কিছু বিদ্রপ মিশাটয়া 
দিলাম। 

মৃন্ময়ী বলিল, না, বয়স হবার পর জানতে পেয়েছি কিছু সত্য ছিল । যাকগে, 
এতকাল পরে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, খুবই আনন্দের কথা । 

ছোটবেল! বাবা আমাকে বাইবেল হইতে দশ আজ্ঞা মুখস্থ করাইয়া ছিলেন। 
যতদুর স্মরণ করিতে পারি, তাহার ভিতর শতকর! নব্বই ভাগ পালন করিয়াছি, 
উহাদের মধ্যে ব্যভিচার” শব্টার অর্থ বুঝিতাম না বলিয়। গোপনে দিদিমাঁকে 
অনেকবার প্রশ্ন করিয়াছি, তিনি বলিতেন, বড় হইলে বুঝাইয়া দিব। বয়স 


১০ 


£ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


হইবার পূর্বে দিদিমা মরিয়া গেলেন, স্থৃতরাঁৎ বাভিচার বুঝিতে পারিলাম না। 
আজও মৃন্সয়ীর সহিত আলাপ কবিতে গিয়া একটু উৎংস্থক হইয়া ভাবিলাম, 
আর যাহাই হউক, ইহার সহিত কথানাতি৭ কহিলে ব্যভিচার হইবে না । মেয়েটা 
যে প্রেতিনী নভে, বরং পন্বাপ্তযৌবনা পুবর্পত্রিচিত এক তরুণী, ইহাতে আর 
সন্দেহ রহিল না । বপিলাম, সত্যই অনেককাল পরে দেখা, আমিও খুশী হলুম। 
তুমি যাই বলো, বাবার কিছু দোষ নেই, দোষ হচ্ছে সেই বেটা ওয়ারেন্‌ 
হেষ্টিংসের, যার আমল থেকে জমীদারীর আরম্ত। এখন থাকো কোথায় 
তোমরা ? 

মৃন্ময়ী বলিল, কলুটোলায় । 

এত বাঁড়বুষ্টিতে কি যেতে পারবে ? এক বেধিয়েছ কেন এই ছুযোগে ? 

মুন্মরী চুপ করিয়! যখন রেলপথের দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল, আমি সেই 
স্থযোগে তাহার দিকে একবার চাহিলাম । আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট 
ছিল মনে পড়িতেছে। দনিদের ঘরের মেয়ে বলিয়া স্বাস্থ্য ছিল বলিষ্ঠ ও 
নিটোল । সেই বয়সেই ইহার গল। পরিয়া “শিবের গাজন"' গাহিতে দেখিয়! মা 
রুষ্ট হইতেন, অর্থাৎ ইহাই ভয় ছিল, পাছে ইহার উদীয়মান কৈশোরের ঘন 
গন্ধে আমার কিশোর মনে কোনো নেশা লাগে । ইহার আজিকার আকম্মিক 
আবির্ভাবে সেই অতীত ইতিহাসের পুরাতন পথ বাহিয়! পুনরায় সেই বিচিত্র 
গন্ধটা কেমন করিয়া যেন মুহৃতের জন্য আপ্রাণ করিলাম। কিন্ক আমি যে 
জমীদার, ইহা ভুলিলে আমার চলিবে না, আমার আভিজাত্যের অহংকারে 
ইভা ও অনস্থীকার্ধ, এবং নারীর সান্লিধালাভের জন্যও যে আমার আগ্রহ রহিয়াছে, 
তাহাই বা অস্বীকার করিব কেমন করিয়া? 

বলিলাম, বেঞ্চে জায়গা আছে, একটু বসতে পারো । এত বৃষ্টিতে যাওয়া 
সম্ভব নয়। একটু ধরুক। 

সৃন্নয়ী করুণ হাসিমুখে বলিল, জমীদারের পাশে প্রজা কি একাসনে বসতে 
সাহস পায় ? 


ঝড়ের সন্ত 


সে কথা ঠিকই বলেছ। পৈতৃক আদর্শ আমিও খুব মেনে চলি। কিন্তু 
কলকাতা শহরটা বড়ই আজগুবী। এখানে শ্রলাল চামারের বাড়ীতে 
ভাটপাড়ার ব্রহ্গণেরা ভাড়া থাকে । ভয় নেই, বসো এখানে । একটু ফাক 
রাখো, তাস্হগলেই হবে। 

ফাক রাখিয়! আমার পাশে সে বসিল বটে, কিস্য তাহাকে উস্থুস করিতে 
দেখিয়া মনে মনে একটু কুপিত হইলাম । ধনীর পুত্র বলিয়! আমার ভিতরে এমনি 
একটা আম্মাভিমান ছিল যে, আমার অন্তবোঁপধকে আদেশ বলিয়। কেহ মানা না 
কবিলে আমার খুন চাপিয়া যাইত 1 কিন্ত দেখিয়া মনে হইল--ইহাকে সে কথ! 
স্মরণ করাইর! দে ওয়! বুথ! । আজ সে হাতের বাহিরে চলিয়] গিয়াছে; স্ৃতরা* সে 
মান রাগিতে না চাহিলে, জোর কর। চলিবে না। এদিকে আবার এক তরুণী 
পাশে বপিয়াছে অনুভব করিয়। পুলক-শিহরণগ কিছু লাগিয়াছে বৈকি ! বিবাদ 
বাধাইয়া, তর্ক তুলিরা এমন একটি সন্ধ্যাকে ব্যর্থ করিতে ও আমার মন উঠিল না । 

সাহস করিয়া বলিলাম, আচ্ছা, তোমার ডাক-নাম ছিল বোধ হয় মীন, নয়? 

মনে আছে দেখছি আপনার ' 

মনে তৃমিই করিয়ে দিয়েছ । একটা ম্মতির টানে আর একট! এসে হাজির 
হয়। তোমার সঙ্গে কেউ নেই কেন বলে। ত? 

কেউ থাকলে কি আপনি খুশী হতেন ?-_-এই বলিয়! সে পুনরায় হাসিনুখে 
আমার দিকে তাকাইল। তাহার হাসির ভিতরে আমি সেই চিরকালিনীর 
ছলনা দেখিতে পাইলাম না; হ্য়ত ভুল করিয়াই আমার মনে হইয়া গেল, 
অনেকক্ষণ হইতে একটা ব্যথার কাহিনী সে যেন কেবলই চাপিয়। যাইতেছে । 
তাহার চঞ্চল ও উদভ্রান্ত চক্ষু আমার ভিতরেও যেন অস্বস্তি আনিতেছিল । 
আমি কেবল একবার পথের দিকে তাকাইয়! বলিলাম, কোনো ইঙ্গিত আমি 
করিনি স্বণ্ময়ী, কেবল বলছিলুম, ভয়ানক দুর্যোগ, তুমি যেতে পারবে না । 

কস্বর আমার করুণায় বিগলিত হয় নাই, ইহা যে আমার ভবিষ্তাৎ 
প্রণয়কাণ্ডের একটা আভাস--এমন একটা উদ্ভট কল্পনাকে ও আমি মনে মনে 


€ 


বড়েবু সঙ্কেত 


প্রশ্রয় দিতেছি না, কিন্ত এই দুরধ্ধোগে একজন তরুণীর একাকিত্বের প্রতি একটা 
বিবেচনা ও কতব্যবোধ ছিল। আমার সচেতন আভিজাত্য কলঙ্কবতী 
সরোজিনীর কন্যার প্রতি অবশ্যই বিভৃষ্ণ; কিন্তু যে-মীন্থ আমার গলা ধরিয়া 
শিবের গাজন গাহিত, তাহাকে বাদলের বন্যায় নিষ্করুণভাবে ঠেলিয়া দিতে 
আমার মন উঠিল না । 

প্লাটফরম হইতে লোকজন একে একে চলিয়া গেল, বৃষ্টির ঝর-বর 
ধার! অবিশ্রীন্ত ঝরিতেছিল, এব সেই নির্জনে আমরা ছুইজন বসিয়া 
ব্রহিলাম । 

এক সময়ে সহসা সে উঠিয়া ঈাঁড়াইল। বলিল, আচ্ছা, আপনি বন্থুন, 
আমি এবার এগোই | 

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, কী বলছ তুমি? আর কিছু না হোক, কাপড় 
চোপড় ভিজে গেলেও যে বিপদে পড়বে? 

উপায় নেই বাজেনবাবু, আমাকে ফিরতেই হবে তাড়াতাড়ি। আচ্ছা, 
নমস্কার ।-_এই .বলিয়া সটান পিছন ফিরিয়া, একটুও অন্তরঙ্গতার চিহ্ন না 
রাখিয়া, দ্রতপদে তাহার হিল্‌্তোলা জুতার খটখট আওয়াজ তুলিয়া সে চলিয়া 
গেল। পুরাতন পরিচয়ের কোনো মূল্যই দিয়া গেল নাঁ। প্লটফরম ছাঁড়াইয়া 
স্টেশনের বাহিরের দিকে অপৃশ্য হইয়া গেল। 

সেই রাত্রি, বুষ্টি ও ম্ঘগর্জন, ঝপসা আলো, ইতস্তত ধাবমান যাত্রীর দল,__ 
সমস্তট! মিলিয়া মনে হইল, ইহা যেন ক্ষণকালের একটা স্বপ্ন । ইহার জন্য 
কালবৈশাখীকেই দায়ী করিলাম। এমন ঘটনা ঘটে জীবনে । ঝড় উঠিয়া 
সব কিছুকে স্থানচ্যুত করে, অদ্ডুতের অবতারণা ঘটে । স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি 
থাকে না, চরিত্রের সঙ্গে তাল মিলাইয়া চলে না। দম্কা বাতাস উঠিল, 
অতীতকালকে টানিয়৷ আনিয়া বত'মানের উপর নিক্ষেপ করিল, আমার ভাবনার 
ধারাকে নৃতন খাতে প্রবাহিত করিল। ফল এই হইল যে, নৃতন করিয়া আর 
সিগারেট ধরাইবার উৎসাহ পাইলাম না, বরং সমস্ত পথটা ধীরে ধীরে বৃষ্টিতে 


ঙ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ভিজিয়! বাড়ী কিরিবার জন্য এক সময়ে গ! ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দীড়াইলাম | 
কেমন একটা ক্লান্তি ও বৈরাগ্য আসিয়! ঘিরিল। 

স্টেশনের বাহিরে আসিয়া পা বাড়াইতেই পুনরায় মৃন্ময়ীকে দেখিয়া আমি 
সচকিত হইলাম। যাহা বলিয়াছিলাম তাহাই হইয়াছে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে 
কাপড় চোপড় ভিজাইয়া সে বিপন্ন হইতে চাহে নাই। কাছে আসিয়া বলিলাম, 
যেতে পারোনি ত? 

মনে হইল, আমাকে দেখিয়া সে আর খুশী হয় নাই। দেখিলাম-_ মৌখিক 
সৌজন্য প্রকাশ করিবার মতো বতর্মান অবস্থা তাহার নহে। সে কেবল বলিল, 
ভারি বিপদে পড়লুম । 

বলিলাম, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহ'লে আমার গাড়ীতে তোমাকে 
পৌছে দিতে পারি । 

এই কথাটা শুনিবার জন্য সে যে এমন করিয়া প্রস্তুত হইয়াছিল, তাহা 
জানিতাম না। তাহার সমস্ত গাভীধ যেন সহসা চুরমার হইয়! গেল। ব্যাকুল 
হইয়া সে বলিল, মান অপমানের প্রশ্ন এখন আমার নেই, আমার বড়ই বিপদ্‌। 
আমাকে দয়া ক'রে শীঘ্র পৌছে দিন্‌। 

তংক্ষণাৎ ট্যাকৃসি ডাকিলাম। সে উঠিয়া বসিল, আমিও উঠিয়া তাহার 
পাশে বসিলাম ৷ ড্রাইভারকে নিদেশি করিলাম, কলুটোলা । 

বৃষ্টির ভিতর মোটর যখন ছুটিয়া চলিল, আমি তাহাকে প্রশ্ন করিলাম, 
ব্যাপারট!1 কি বলো দেখি? তোমার মা কোথায়? রী 

উচ্ছ্বসিত কে সে কহিল, তাঁকে নিয়েই ত সব বিপদ্‌ ! 

তাহার কঠস্বরে আমার সন্দেহ হইল | পুনরায় প্রশ্ন করিলাম, বিপদ্‌টা কি 
শুনি? 

শুনলে প্রতিকার করতে পারবেন না, রাজেনবাবু । মা আমার 
মৃত্যুশষ্যায় ।-_-এই বলিয়া মৃন্ময়ী হঠাং কীদিয়া ফেলিল। 

মৃত্যুশয্যায় ! কী বল্ছ? তাকে ফেলে তবে তুমি বেরিয়েছে কেন? 


৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


অশ্রজড়িত কণ্ঠে মৃন্সয়ী বলিল, এই গাড়ীতে ধার আসবার কথা ছিল, 
তিনি মায়ের পরম শক্র। কিন্ত সে পাষণ্ড এলো না। আমি কি করি 
বলুন ত? 

পিতার অপেক্ষাও কুপণ বলিয়! বন্ধুপমান্জে আমার একটা ছুনপম ছিল। 
যেখানে স্বার্থ ও লোভের খাগ্য নাই, সেখানে অর্থব্যয় কর! আমার প্রর্তিবিরুদ্ধ। 
কিন্ত সহসা গাড়ীর ভিতর বসিয়! অশ্রমুখী মৃণ্ময়ীর প্রতি সহ প্রকাশ করিয়া 
বলিয়া ফেলিলাম, তোমার কি টাকাঁকড়ির দরকার আছে? 

তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়৷ পুনরায় বলিলাম, যাকে পরম শত্রু 
আর পাবগু ব'লে অভিহিত করছ, তার জন্তে তোমাদের এই ব্যাকুলতা কেন, 
মৃখয়ী? 

বড়বাজারের ভিতর দিয়! গাড়ী চলিতেছিল, বুষ্টির ছাট্‌ বাচাইয়া৷ আমরা ছুই 
জনে গাড়ির গদির মাঝামাঝি বসিয়াছিলাম। মুণ্ময়ী মুখ তুলিয়া বলিল, আপ- 
নার কাছে কিছু প্রকাশ করা আমার পক্ষে শোভন হবে না; তবে এইটি ব'লে 
রাখি, যেদিন আমাদের ঘর জালানো হয়েছিল, সেদিন আমাদের যে অসহায় 
অবস্থা ছিল, আজো তেমনি আছে। 

কেমন যেন আঘাত পাইয়া চুপ করিয়া রহিলাম। কিন্তু দরিদ্রের বেদনার 
, ইতিহাস শুনিয়া অথবা বঞ্চিতের অশ্রু দেখিয়া মমতায় বিগলিত হইব, কিস্বা 
তাহার জঙ্ত স্বার্থত্যাগ করিব, প্রাণ দিব, নিজের ভবিস্তৎ জীবনতরী ড.বাইব 
এমন ভাবালুতা আমার নাই। নিজের সহিত কতথানি সংগ্রাম করিয়া 
যে একটু আগে তাহাকে টাকা দিব বলিয়া একট! (বেপরোয়া প্রতিশ্রুতি দিলাম, 
এবং তাহার জন্য মনে মনে যে এখনি অনুশোচনা আসিয়াছে, তাহ বুঝাইবার 
জন্য বুহং মনত্বত্বের শাস্্ব আওড়াইবার প্রয়োজন নাই, ভূক্তভোগী মাত্রেই 
তাহ! বুঝিয়া লইবেন। বাল্যপরিচয়ের কথাটা তুলিয়া মেয়েটা আমাকে একটু 
দমাইয়া দিয়াছে, কেমন একটা অযৌক্তিক আত্মসন্মানের প্রশ্ন আসিয়! পড়িয়াছে, 
নচেৎ বিপন্ন যুবতীকে টাকার লোভে ভুলাইয়া এতক্ষণ আমি অন্য পথ ধরিতাম। 


৮ 


| 


চু 
চু 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমার পরম গুরু পিতার নৈতিক বিচারের প্রতি ইহার বারবার কটাক্ষ 
আমার পক্ষে সা কর! কঠিন, ইহা তাহাকে জানাইয়া দিবার বাসনা হইল; 


তাহার মৃত্াশয্যাশায়িনী জননীর প্রতি আমার যে একটুও দরদ নাই, ইহা 


জানাইয়। দিবার ইচ্ছা করিতেছিল | পুখিবীর লৌক মনে করিবে, আমি মহত্ত্ব 
প্রকাশ করিতেছি , বোকা জনসাপারণ সন্দেহ করিবে, আমি একটি বিপন্ন 
তরুণীকে উদ্ধার করিবার জন্য মোটর ভাড়া করিয়া ছুটিমাছি, আমি দয়ার 
অবতার,_-তাহাদের সন্দেহ ভগ্নার্থ আমি গাড়ীর ভিতর বসিয়া! এখনই আমার 
পাশবিক স্বরূপ সহজেই প্রকাশ করিয়া দিতে পারি এবং তাহার জন্য কোনবূপ 
বিপদ ঘটিলে বড়লোকের ছেলে বলিয়। অনায়াসেই পরিজ্রাণ পাইব, .. কিন্তু 
একট! কুংগিত বৈষ্ণবী-দয়া আপিয়া আমার অক্ত্রিম পৌরুযকে আচ্ছন্ন 
করিল। মুখে কেবল বলিলাম, তোমাকে পৌছে দিয়েই আমি চলে যাবো, 
কেমন ? 

মুন্নয়ী বলিল, তাই যাবেন, আপনার বড় কষ্ট হোলো । 

কলুটোলার এক গলির মোড়ে আপিয়া মোটর পাড়াইল। সে তাড়াতাড়ি 
নামিয়া একটা মৌখিক ধন্যবাদ না দিয়াই যখন পলাইবার চেষ্টা করিল, তখন 
আমি হঠাৎ সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিলাম। কলিকাতা রাজধানীর একটি বিশেষ খাতি 
আছে, এখানকার নরনারী বিচিত্র । মনে করিলাম, সমস্থটাই হয়ত প্রবঞ্চনা, 
হয়ত আমাকেই ভুলাইয়। একটি তরুণী এই বৃষ্টি-বাদলের দিনে গাড়ী চড়িয়া 
আসিয়া বাড়ী ঢুকিল। হয়ত ইহার অপিক দূর অগ্রসর হইলে আমাকে ব্র্যাক- 
মেল করিয়। টাকা পয়সা ছিনাইয়া লইবে ৷ সংসারে কিছুই অসম্ভব নয় । 

কিন্ত ব্লাকৃমেলের? ভয় করিব বড়লোকের ছেলে হয়! ? অভিজাত বংশের 
ছেলের নামে যদি একটু নিন্দাই ন! রটিল, তবে বাচিয়া থাকাই বুথ! । হয়ত 
ধন্যবাদ না দিয়া পলাইবার সঙ্কেত এই যে, আমি তাহাকে অনুসরণ করিব। এক 
মুহতও বিলম্ব করিলাম না, ট্যাকৃসিকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া গাড়ী হইতে বৃষ্টি 
মাথায় করিয়া নামিয়া আমি ভ্রুতপদে মৃন্ময়ীর অনুসরণ করিলাম । একটা দ্ুদ্ণন্থ 


তে 


ঝড়ের সঙ্কেত 


খেলায় আমি মাতিয়া উঠলাম । এমন একটা লোভের উপকরণকে কিছুতেই 
হাতছাড়া হইতে দিব না। 

দরজার কাছে আপিয়া তাহাকে ধরিলাম | মুন্সয়ী বিশ্মিত হইল না, কেবত 
বলিল, আসন্ন আমার সঙ্গে সাবধানে, নীচেটা বড় অন্ধকার | - 

একবার গ৷ ছম ছম করিয়া উঠিল। নিঃশ্বাসের দ্রুততা চাপিয়া সন্তর্পৎে 
উপরে উঠিতে উঠিতে বলিলাম, শহবের এদ্রিকটায় অনেক গুণ্ডার আড্ডা, এখানে 
থাকতে তোমাদের ভয় করে না, যুন্য়ী? 

ভয়টা গরীবের জন্যে নয়, রাজেনবাবু। 

তাহার কথায় আমার মুখখানা যেন ভোতা হইয়া গেল। কিন্তু কি করিব 
অভিজ্ঞত। আহরণ করিতে আপসিয়াছি, মান-অপমানের প্রশ্ন তুলিলে এখন চলিবে 
না। আমি তাহার পিছনে পিছনে উঠিয়া! উপরে আসিলাম। 

প্রকাণ্ড বাঁড়ীর উপর তলাকার একটি ক্ষুদ্র অশ। পাড়া, পল্লী, চেনা- 
পরিচয় কোথাও কিছু নাই, এতটুকু অবকাশ খুজিয়া পাওয়া! যায় না ... চারিদিক 
যেমন জমাট তেমনি নিবেট। দালানের দরজাটা একবার বন্ধ করিয়। দিলে 
পৃথিবীর সহিত আর কোন সম্পর্ক থাকে না। কেহ মরুক, কেহ খুন হউক, আত্ম- 
হত্যা করুক, কেহ জানিবে না । কোথায় একট। ছাপাখানা হইতে ফ্লাট মেশিনের 
একঘেয়ে শব্দ কানে আসিতে লাগিল। আমি একবার মুহতে বর জন্য অশীম 
সাহস লইয়া স্তব্ধ হইয়া দাড়াইলাম । আমার জামার সোনার বোতাম, হাতে 
মোনার হাত ঘড়ি, পকেটে মনিব্যাগ, এবং আমার পৈতৃক প্রাণটা ... এই চারি 
বন্ধ একত্র এক নিমমেনের জন্ত অনুভব করিরা লইলাম, তারপর ঢোক গিলিয়া 
প্রশ্ন করিলাম, কোথায় তোমার মা, মৃণ্ময়ী ? 

এই যে, এই ঘর.-'বলিয়া মৃন্ময়ী আমাকে লইয়া একটি ঘরে ঢুকিল। 

অবশ্য সমস্তই সত্য। রোগীর সৃত্যুশয্যা সাজাইয়া আমাকে প্রতারিত 
করিবার ফন্দি নাই। বালাকালে যে “মাসীমার” ঘরে বসিয়া জলযোগ সম্পন্ 
করিতাম, তাহাকে অবশ্য চিনিতে পারিলাম না। প্রথমত, কালের ব্যবধান ; 


১০ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


দ্বিতীয়ত, চেহারাটা বিকৃত, রোগশীর্ণ। মৃত্যুর ছায়া ঘনাইয়াছে। আর বেশি 
দেরি নাই । সংজ্ঞার চিহ্ন দেখিলাম না, কেব্ল নিশ্চল অনড় একটি কঙ্কাল 
পড়িয়া আছে, কের মূল কেবল মাঝে মাঝে কাপিতেছিল। রোগের 
ইতিহাস শুনিবার প্রবৃত্তি হইল না, সহানুভূতি জানাইধার উৎসাহ আমিল না, 
কেবল চুপ করিয়া রহিলাম | সহসা মনে হইল, মৃন্সয়ী পিছন কিপরিয়া কাহাকে 
কী যেন ইসারা করিতেছে । তড়িংগতিতে কিরিয়া আমি প্রস্তুত হইলাম, 
পুনরায় আমাকে সন্দেহে ঘিরিল। চাহিয়! দেখিলাম, ঘরের একান্তে ছুইটি 
যুবক এতক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়াছিল, লগনের স্তিমিত আলোয় আগে তাহাদের 
লক্ষ্য করি নাই। 
মৃন্নরী বলিল, কিছু আছে, মনে হোলো ? 


না। 

আবার সে কীদিয়! ফেলিল, বলিল, ডাক্তার দেখাবার অবস্থা আর নেই জানি, 
হয়ত আর এক আধঘন্টা। কিন্তু আপনি এই উপকারটুকু করে? যান। 
স্থধু হাতে টাকা আমি কোথা পাবো না, এই চুড়ি ছু'গাছা। বিক্রি ক'বে 
আমাকে কিছু টাকা এনে দিন্‌। 

যুবক ছুইটিকে দেখিয়া আমার মন দ্বণায় ভরিয়। গিয়াছিল। চুড়ি ছু'গাছ। 
তাহার হাত হইতে লইয়। পরীক্ষা করিয়া বলিলাম, সোনার চুড়ি ত' ঠিক? 

ঠ্যা, সোনারই | 

আচ্ছা চললুম, বোপ হয় পারবো আনতে । বলিয়। একবার বাহিরে পা 
বাড়াইলাম, এবং সেখান হইতেই পুনরায় ডাকিলাম, একটু এসে৷ আমার সঙ্গে, 
কথা আছে। 


গোপন প্রশ্ন করিবার সময় ইহা! নহে মৃত্তাুপথযাত্রীর পারিপাস্থিক অবস্থার বিচার . 


করিবার অবসর ইহা! নয়; কিন্ত স্বার্থ -ও নিষ্ঠুরতা আমার সহঙ্গাত, একথা আমার 
ভুলিলে চলিবে না। আমার শীকার অন্তে হস্তগত করিবে, ইহার ভিতরে আমি 
যেমন আমার অক্ষমতার দৈন্য দেখিলাম, অন্যদিকে তেমনি আমার প্রতিহিংসার 


১১ 


ঝড়ের সঙ্বেত 


বহ্ছি জলিয়া উঠিল। মানুষের জন্ম হইলেই মৃত্ত্যু হয়, তাহার জন্য দুঃখ করিয়া 
লাভ নাই; কিন্তু মৃত্যুশয্যা দেখিয়! উদভ্রান্ত হইয়া! আমি আমার কড়া ও গণ্ডা 
ত' ছাড়িতে পারি না। 

মুন্সী অন্ধকারে আমার সহিত মাঝপথে নামিয়া আসিল। আমি টুপি চুপি 
বলিল।ম, ঢাঁকাঁাকি আমার কাছে নেই মীন্ট, একটা কথা আমাকে সত্য 
করে বলো । 

কি বলুন? 

মনের আক্রোশ চাপিয়! সংযত কে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমাদের কেউ 
নেই বলেছিলে, তবে ওই ঘণ্ডামার্ক। ছোক্‌র! দু'জন কে? 

ওদের উপর বাগ হোলো কেন আপনার ? 

রাগ হয় নি মৃন্ময়ী, ঘ্বণ। হয়েছে তোমাদের সকলের ওপর । 

মৃন্সরীর মুখ অন্ধকারে দেখিতে পাইলাম না । কিন্তু সেকরুণ কগ্ে কহিল, 
এখন আমার বড় অসময় রাজেনবানু, আমার ওপর অবিচার করবেন না। 

কঠিন নিয় কণ্ঠে বলিলাম, "ওদের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা জানলে তবেই 
আমি নিজের ইতিকত ব্যটা ভাবতে পারবে|। 

ওরা আমার কেউ নয়, ওরা পথের লোক । 

তবেকে এব? 

পরিচয় পরে আপনাকে জানাবো । আমাকে ক্ষমা করুন, সেটা খুবই 
গোপনীয়। 

গোপনীয়! তীব্রক্ে বলিলাম, না, এখনি তোমাকে বলতে হবে । 

মুন্সয়ী একটু ইতস্তত করিয়া রুদ্বশ্বাসে বলিল, বেশ এখুনি বলব। কিন্তু 
বাইরে যদি কোথাও আপনি প্রকাশ করেন তবে আপনিই বিপদে পড়বেন । 
ওদের কোনে! পরিচয়ই আমি জানি নে; এইটুকু জানি, ওবা বিপ্লবী । মা 
ওদের পলাতক অবস্থায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই বলিয়া পুনরায় দ্রুতপদে 
উপরে উঠিয়। গেল৷ 


১২ 


দুই 


মোটরে করিয়া ভিজতে ভিজিতেই বাঁড়ী আপিয়া পৌছিলাম। কাল বেশাধীর 
ছুধোগে সন্ধ্যারাত্রে আমার জীবনে এমন একটা নাটকীয় ঘটন! ঘটিল যে, সহসা 
কাহার নিকট প্রকাশ করিতে উৎসাহ পাইলাম না। পথে ঘাটে অসংখ্য যুবক 
যাহারা অজ্ঞাত অপরিচিত হইয়া! চপিয়! ফিরিয়া বেড়ায়, আমি ছিলাম তাহাদেরই 
একজন, কিন্তু সেই রাত্রে বৃষ্টি-বাদলে কলিকাতার বৃহস্তময় পথে ভিজ! অন্ধকারে 
আর ঝাপসা আলোয় মোটবের ভিতর বপিয়া আমি যেন সহসা! এক নাটকের 
প্রধান নায়ক হইয়া উঠিলাম। তরুণ বয়সের রস-কল্পনায় যে-সকল অবণচীন 
গা ভাসাইয়া দেয়, তাহার। এক একট। নাটকীয় সংস্থানে আম্মহারা প্রণয় কাঠি- 
নীর বিঘবস্ত খুঁজিয়া পাইত, কিন্তু আমি ইহীতে একটা বৈনগ্িক লাভের সন্ধান 
আবিফার করিলাম। ছুই গাছ সোনার চুড়ি পকেটের ভিতরে রাখিয়গহাত 
দিয়া মাঝে মাঝে অনুভব করিতেছিলাম। সুন্সয়ী হাত হইতে চুড়ি খুলিয়! 
দিয়াছে, কিন্তু আমার ঠিকান| লয় নাই। যদি টাকা লইয়। মামি ফিরিয়া না 
যাই, তবে কিছুই তাহার করিবার থাকে ন।। এমন কোন প্রমাণ তাহার 
নিকট বাখিয়া আলি নাই, যাহার জোরে সে চুড়ি ছু'গাছ। ফিরিয়া পাইবার দাবী 
জানাইতে পাবে । প্রতারিত হইতে গিয়া প্রতারণা করিম আমিলাম, এজন্য 
নিজের গ্রতি শ্রদ্ধা জাগিল। চুড়ি দুগাছা যখন পাইলাম, তখন মোটরভাড়াটা। 
পকেট হইতে দিতে গায়ে লাগিবে বলিয়! মনে হইল ন!। 

মুন্নী আমাকে বিশ্বাস করিয়াছে, এমন একটা কথ। উঠিতে পারে। কিন্তু 
যাহার মা ছিল কলঙ্কবৃতী, যাহাদের জীবনযাত্রার ইতিহাসে সাধুতার কোনও স্থান 
নাই, তাহাদের নিকট সাধু বলিয়৷ পরিচিত হইবার মুল্য কতটকু? মেয়েটার 
প্রতি আমার একট! ক্ষণিক লোভ জাগিয়াছিল সন্দেহ নাই, উহার সহিত কিছু- 
কাল একটা সম্পর্ক পাতাইলে মন্দ হইত না, কিন্তু সোনার চুড়ি ছুই গাছা পাইয়| 
আমার সেই লোভটা কোথায় ষেন উবিয়া গেল। তাহার সহিত পুনরায় সাক্ষাৎ 


১৩ 


ঝড়ের নঙ্কেত 


করিলে চুড়িবিক্রয়ের টাকাও তাহাকে দিতে হইবে এবং তাহাকে হয়ত পাইব না, 
এমনও হইতে পারে বিপ্লবী বলিয়া! কথিত দুইটি যুবকের দ্বারা আমার কোনও 
ঘোরতর অনিষ্ট হওয়াও বিচিত্র নয়, তাহার চেয়ে বরং সমস্তটাই গিলিয়া ফেলি। 
চুড়ি দু'গাছ৷ বিক্রয় করিয়া! যাহা পাইব, তাহাতে অমন পাঁচটা সৃন্ময়ী জুটিয়া 
যাইবে । মুন্ময়ী অপেক্ষা স্ীলোকই আমার নিকট প্রধান__-এমন আদর্শ ও ইহার 
উদাহরণ আমার জীবনে বিরল নয়। খুশি হইয়া বাড়ী আসিয়া পৌছিলাম। 
সৃন্সয়ী এতক্ষণ তাহার মায়ের স্ৃত্যুশয্যার পাশে বসিয়া প্রতি মুই্তটি গণিতেছে, 
এই অস্থবিধাজনক অবস্থাটা ভাবিয়া দেখিবার প্রয়োজন আমি আর মনে 
করিলাম না। 

বাড়ীতে ঢুকিয়া মাতৃদেবীকে দেখিয়াই মনে পড়িল যে আমি পিতাকে আনি- 
বার জন্য স্টেশনে গিয়াছিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়াই বলিলেন, কই রে, 
এরা*এলেন না? 

তাহার বহুবচনার্থ শুনিয়। রাগ হয়! গেল। বলিলাম, তোমার পতি-পরম- 
গুরুটি চিরদিন আমাকে এমনি হ্র়রাণ করেন । 

আমি আদরের পুত্র, স্থতরাং বেমকা কথ! বলাই আমার অভ্যান। মা 
বলিলেন, আ, মুখপোড়া । ওই কি তোর কথার ছিরি? তবে কি দিল্লি থেকে 
রওন! হতেই পারেন নি? 

বলিলাম, খুব সম্ভব লাড্ড, খেয়ে স্ত্রী পুত্রের কথ! ভুলেই গেছেন। ভদ্রলোক 
আমার দাজিলিং যাওয়াটা মাটি ক'রে দিলেন। 

মা রাগ করিয়া বলিলেন, কেবল নিজের যাওয়ার কথাটাই ভাবছিস, এদিকে 
মানুষটার পথে বিপদ আপদ কিছু ঘটলে! কি না সেদিকে তোর জক্ষেপ নেই ! 

বলিলাম, তীর বিপদের চেয়ে বড় বিপদ যদি আমার দাঁজিলিং যাওয়া না! হয়। 

দূর, পোড়ারমুখো । বলিয়৷ মা চলিয়া গেলেন। 

কথাটা মিথ্যে নয়। পিতা আমার এমনি সতর্ক ও সাব্ধানী পুরুষ যে, 
তিনি বরং অন্যকে বিপদে ফেলিবেন কিন্তু নিজে বিপন্ন হইবেন না। তাহার 


১৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


[বিপদের কথা ভাবা অপেক্ষা আমার দা'জিলিং যাত্রা অনেক বড়। দিলী হইতে 
কিরিবার পথে ট্রেণ- সংঘর্ষে তাহার মৃত্যু অপেক্ষা কলিকাতায় বপিয়া একশো পাঁচ 
শুডিক্রী উত্তাপে আমার শোচনীয় মুমুষ্ূ অবস্থা অনেক বেশি যন্ণাদায়ক। পিতা! 
£মরিলে ছুঃখ নাই, কারণ পিতারা চিরদিনই মরিয়৷ থাকেন, কিন্তু আমার ন্যায় 
পুত্র মরিলে সমগ্র জাতির পক্ষে ক্ষতিকর, দেশের পক্ষে অপূরণীর অভাব, 
দেশকে এতবড় অনিষ্ট হইতে আমি অবশ্যই রক্ষা করিব। আগামী কাল মৃন্ময়ীর 
সোনার চুড়ি বিক্রয় করিয়। ও মায়ের অলঙ্কার বন্ধক রাখিয়া আমি কলিকাত। 
ত্যাগ করিব । পিতা আমার চিরদিনই স্বার্থসচেতন, সুতরাং আমি যে 
কায়মনোবাক্যে তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিব, ইহাতে বিস্ময়ের কি আছে? 
মাতাঠাকুরাণী অলঙ্কার না দিলে অহিফেন সেবন করিয়া আত্মহত্যা করিবার 
নামে মদনানন্দ মোদকের বড়ি দেখাইয়। ভয় প্রদর্শন করিব । এমন অনেকবার 
করিয়াছি। আমার কুড়ি বদর বয়স অবধি আমি অবশ্ত ন1 বলিয়। কয়েকবার 
গোপনে পিতৃদেবতার বাক্স হইতে কিছু কিছু লইয়াছি, কিন্তু পিতা! মাতার দ্বিতীয় 
সন্তান জন্মগ্রহণের সম্ভাবনা! চলিয়! যাইবার পর হইতে আমি আফিও ও দর়ি_ 
দুইটি শব্দ উচ্চারণ করিলেই আমার পায়ের নিকট আসিয়া টাকা-পয়সা জড়ে| 
হইতে থাকে । অবশ্য এখনো একটু অস্বস্তি আছে, উভয়ের একজনের মৃত্যু না 
হইলে আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেছি না। বল! বাহুল্য, দুইজনেই এমন 
বয়সে উত্তীর্ণ হইয়াছেন যে, একজন মৃত্যুমুখে পতিত হইলে অপর একজন যে 
' পুনরায় বিবাহ করিবেন, এমন সম্ভাবনা কম। তবে বাংলা দেশে লবই সম্ভধ, 
পিতার ন্যায় বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে কিশোরী পাত্রী জুটিতে বিলম্ব হয় না। তবে 
মাতৃদেবীর সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত, তাহার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে, অবশ্ত বিলাত হইলে 
কি হইত বলা যায় না। 

মনে মনে এই সব যুক্তিপূর্ণ আলোচন। করিতে করিতে আমি আমার 
টেবলের নিকট স্থির হইয়! বপিয়া চুড়ি ছু'গাছা বাহির করিলাম। আগামীকাল 
আমার অনেক কাজ। কিছুকাল হুইতে যে ছুই একটি বদঅভ্যাস আমার 


১৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


হইয়াছে, তাহার জন্য যদিও আমি আন্তরিক লজ্জিত ও অন্তপ্ত, যদিও আমার 
হ্যায় কুলাঙ্গার সমাজের পক্ষে ত্বণ্য, কিন্তু কি করিব, আমার অভ্যাসগুলি 
দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হইয়াছে । অহিফেন অবশ্য আমি সেবন করি না, তবে 
উংকুষ্ট বিলাতী মগ্য আমি একরূপ নিররমিত ব্যবহার করিয়া থাকি । স্থতরাং 
তাহার সরঞ্জাম এই পরিমাণে লইতে হইবে, যাহাতে পথে ঘাটে, শীতে ও দুর্যোগে 
অভাব না ঘটে! দ্বিতীয় কথাটা স্বীকার করিবার পূর্বেআমি একবার ঈশ্বরের 
নাম করিব, কারণ সকলই তাহার ইচ্ছা_-সেই হৃধীকেশ আমার হৃদয়ে অবস্থান 
করিয়। মামাকে যে কাজেই নিযুক্ত করুন, আমি তাহাই করিয়া থাকি । ঈশ্বরের 
প্রতি আমার অবিচলিত নিশ্বাস ও ভক্তি, তিনি সব্দাই আমার ভিতরে থাকিয়া 
আমাকে চালিত করেন, আমার প্রাণ-চাঞ্চলা তাহারই সন্কেতে নির্দিষ্ট হয়। 
সম্প্রতি থিয়েটার ও সিনেমার ছুই তিনটি অভিনেত্রীর সহিত বহু অর্থব্যয় করিয়। 
অন্তরঙ্গত। স্থাপন করিরাছি,_ উহাদের কাহার মুখে কতটা সতীনারীর ছাপ 
আছে, এবং কাহাকে সঙ্গিনী করিলে আমাকে পথেঘাটে বিশেষ অস্ুবিবায় 
পড়িতে হইবে না, সেই কথা টেবলের নিকট বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। সেই 
সঙ্গে হযীকেশ আমার প্রাণের ভিতর হইতে কানে কানে আদেশ করিলেন যে, 
অলঙ্কার না পাইলে পিতার সহি জাল করিয়া আগের মতো! ব্যাঙ্ক হইতে টাকা 
তুলিয়া লইয়ো, বিপদে পড়িলে একমাত্র বংশধর বলিয়া অবশ্যই পৃবের স্তায় 
উদ্ধার পাইবে। ভয় নাই,_তুমিই ইহাদের শিবরাত্রির সলিতা ! 

কিন্ত চুড়ি দু গাছার দিকে চাহিয়া আমার একটু ভাবান্তর ঘটিল। কিছু 
করিয়া বাঁড়ী ফিবিলে, এই চুড়ি দেখিয়া একটু নেশা লাগিত। কিন্তু তাহা হইল 
না। মনে হইল, এই চুড়ির সহিত মৃন্ময়ীও আসিয়া আমার এই ঘরে দাড়াইয়া 
আমার বিচার বিবেচনাকে নিঃশবে পরীক্ষা করিতেছে । ঘরের আলোটা যেন 
মৃদু, সেই স্বল্প আলোয় আমি যেন দেখিলাম আমার ঘরে সন্ধ্যাবেলাকার বৃষ্টি 
বাদল যেন এই চুড়ি ছু'গাছার পিছনে পিছনে আপিয়া আশ্রয় লইয়াছে। সব 
বুঝিলাম। বুঝিলাম আমার মন্সবাত্বকে বাজাইয়া ইহারা কিছু কাজ গুছাইয়! 


১৬ 


ঝড়ের সন্কেত 


লইতে চাহে । চুড়ি ছু'গাছা যাহার হাতের তাহাকে আমি বাল্যকাল হইতে 
চিনি সন্দেহ নাই, তাহার গলা ধরাধরি করিয়া শিবের গাজন গাহিয়া বেঢ়াইয়াছি 
তাহা ও সত্য, সেদিনকার সেই হ্বষ্টপুষ্ঠ বালিকার মাংসল দেহের উষ্ণ ঘন গন্ধে 
আমার কিশোর রক্তে যে অর্থহীন নিগুঢ় অন্ধ বিপ্রব বাধিয়া৷ যাইভ তাহাও 
নিঃসন্দেহ। কিন্তু আজ? আজ দাঁজিলিং যাইবার কালে ছেলেখেলার মতো! 
একটা সাময়িক সর্ধিনী জুটাইতে পারিলেই আমার কাজ চপিয়া যাইবে । আমি 
সেই লক্ষ্য হইতে ভ্রষ্ট হইয়। অব্ণচীনের হাব মুন্ময়ীর বিপদ্দে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া 
তাহাতে উদ্ধার করিব অথব! বিন। পাবিশ্রমিকে সোনার বদলে তাহাকে টাকা 
দিয়া মৃহানুভবতা! প্রকাশ করিয়া আদিব, এত বড় উদারতা বিংশ শতাব্দিতে 
অচল। মৃন্ময়ীর বয়স কাচা, তাহার ছু'গাছ। চুড়ি গেলে চার গাঁছ। জুটিতে বিল 
হইবে না, কিন্ত আমি এই কালবৈশাখীর লটারিতে যাহা পাইলাম তাহ 
খোয়াইলে আমার দাঙ্জিলিং যাত্রার আধিক সাচ্ছল্য ক্ষুন হইবে। তাহ! 
পারিব না। 

. উঠিয়া ভিতরে গেলাম । পিতা আসেন নাই সুতরাং মা রান্নাঘরে 
পাঁচককে উপদেশ দিয়া পিতার জন্য প্রস্তুত করা খাবারগুলির ব্যবস্থ! করিতে- 
ছিলেন। আমি খাইতে বসিয়া বলিলাম, একট! মজার কথা শুনবে, মা ? 

ম! মুখ তুলিলেন। 

বলিলাম, হাবড়া স্টেশনে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, 
তুমি তাদের চেনো! । 

কে বল্ত ? 

সেই যে তারা, তুমি আর বাবা যাদের পথে বসিয়েছিলে ? 
ওমা, কে রে? 


বলিলাম, তোমরা নিজেদের কলঙ্ক ভুলেছ কিন্তু তারা তোমাদের কীতি 
ভোলেনি। সরোজিনী আর তার মেয়ের কথা মনে নেই ? সেই ষে তোমার 
হুকুমে বাবা যাদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন ? 


১৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ম! বলিলেন, হ্যা হ্যা, মনে পড়েছে । অনেক দিনের কথা হোলো। 
সবনাশী এখনো বেঁচে আছে? 

সরোজিনীর মৃত্যুশয্যার কথাটা আমি ইচ্ছাপূর্বক চি গেলাম । 
মায়ের চোখে মুখে নারীজাতির যে আদিম হিংস্রতা ফুটিয়া উঠিতে দেখিলাম 
তাহাকে প্রশ্রয় দিলাম না । বলিলাম, হ্যা, তার সেই মেয়েটাই এখন বড় 
হয়ে উঠেছে । 

কোথা আছে এখন সে মাগি? 

অত জানিনে, তবে তার মেয়েটা আমাকে দেখে চিন্লো | পুরনো কথা তুলে 
খুব খোটা দিলে । 

মায়ের চোখ জলিয়া উঠিল। বলিলেন, সাপের বাচ্ছা সাপই হয়। ছোবল 
মারবে বৈকি, সেই মায়ের মেয়ে ত? পায়ের জুতো খুলে অমনি মারলিনে 
কেন তুই ? 

মায়ের মুখে এই সকল ভাষা আমি সহসা শুনিতে পাই না। তাহাদের 
অন্যায় ও কলঙ্ক যে কত গভীর তাহা আমি মায়ের মুখের দিকে চাহিয়াই 
উপলব্ধি করিলাম । বলিলাম, তারা কি করেছিল মা? 

মা বলিলেন, সে কথায় আর দরকার নেই । শুধু এই কথা বলে রাখি, 
ফের পথে ঘাটে দেখা হলে আর মুখ ফিরে চাইবি নে। ওরা বড় নোংরা, 
গুদের ছায়! মাড়াতে নেই | 

কিন্তু ছায়! ষে মাড়িয়েছি ইতিমধ্যে । 

মা আমার দিকে চাহিলেন। আমি খাইতে খাইতে বা হাতে চুড়ি ছু'গাছা 
স্রাহাকে সোৎসাহে দেখাইলাম | বলিলাম, সবোজিনীর মেয়ে আমাকে এই ছু'গাছা 
দিয়ে বললে, দয়া করে আমাকে কিছু টাক! এনে দিন্‌, আমাদের বড় বিপদ । 

মা স্তন্ধ হইয়া বসিয়া পড়িলেন। বলিলেন, তুই হাত পেতে নিলি কেন? 

তাহার মুখের চেহারা বিবর্ণ ও যন্ত্রণাকাতর হইতে দেখিয়া আমি প্রথমে 
একটু ষেন অন্ৃতপ্ত হইলাম। কিন্তু পরে বলিলাম, আমি তোমার অত্যন্ত বাধ্য 


১৮ 


ঝড়ের সক্ষেত 


আর চরিত্রবান ছেলে । তুমি যদি আমাকে আগে থেকে শিখিয়ে রাখতে যে, 
ওদের কোনে জিনিষ আমি কখনও স্পর্শ করব না, তা হ'লে আমি একবার 
ভেবে দ্রেখতুম। কিন্তু তুমি তা বলে রাখোনি। এখন কি উপায় তাই বলো 

মা বলিলেন, টান মেরে ফেলে দিয়ে আয় । 

বলিলাম, পরের জিনিষ ফেলে দেবো, অধর্ম হবে যে। তা ছাড় টাকা 
এনে দেবে। বলে হাত পেতে নিয়েছি । আর কিছু নয় মা, জীবে দয়া ! 

মা উঠিয়া দাড়াইয়া বলিলেন, ওই চুড়ি বিক্রি করতে যাওয়া হবে না,-_হুয়ত 
গিল্টি, তুই হয়ত ধরা পড়বি পুলিশের হাতে;--ওরা সব পাঁপই করতে পারে. 
আমি টাকা দিচ্ছি, কুকুরের মুখে যেমন মাংস ছুড়ে দেয়, এই টাক! আর 
চুড়ি তেমনি করে ওদের কাছে ফেলে দিয়ে আসবি। ফিরে এসে চান করে 
ঘরে উঠবি।--এই বলিয়া তিনি রাজমাতা ভিক্টোরিয়ার ন্যায় দীপ্ত ভঙ্গিতে 
চলিয়া গেলেন। উপরের দালান হইতে একবার গল! বাড়াইয়৷ বলিলেন, 
যত রাত্রিই হউক আমাকে যাইতেই হইবে, ওই নোংরা বস্ত ঘরে রাখা. 
হইবে না। 

আহার সারিয়া মায়ের নিকট ত্রিশটাকা লইয়া শুভ-ক্ষণে দুর্গা বলিয়া 
যাত্রা করিলাম। পথে নামিতেই এক সাইকেলওয়ালা ডাকপিওন হাতে 
একখান! টেলিগ্রাম দিল। টেলিগ্রাম বাবার । খুলিয়া পড়িয়া দেখি, তিনি" 
জানাইয়াছেন, তাহার আসা হইল না, দুইদিন পরে আসিয়! পৌছিবেন। মনে 
মনে পিতার মুণ্ডপাত করিলাম এবং মাকে জব্দ করিবার জন্য টেলিগ্রামের কথ! না? 
জানাইয়াই বাহির হইয়া! পড়িলাম। পকেটে ভ্রিশটা টাকা ও সোনার চুড়ি, 
আজ রাত্রিটা ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার ভালোই কাটিবে। ইচ্ছা করিয়! অল্প: 
খাইয়াছি, নেশা! করিবার মতো জায়গা পেটে বেশ আছে। রাত্রে আর 
ফিরিব না, চিরকালের অভ্যাস মতো কাল সকালে আসিয়া! একটা মিথ)।! 
রোমাঞ্চকর গল্প বলিব, এবং আমি জানি মা বিশ্বাস করিবেন। কলিকাতাক 
রাত্রর পথ মধুর বোধ হইতে লাগিল । 


১৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মা যতটা নোংরা বলিলেন ততটা নোংরা আমার মনে হয় নাই। 
স্ত্রীলোকের নিকট স্বীলোক ধতট: নোংরা, এমন তাহারা! পুরুষের চক্ষে নহে । 
পৃথিবীতে স্ত্রী-কবি অনেক জন্মিয়াছেন সন্দেহ নাই, কিম্ক তাহাদের খ্যাতি 
নাঁরীবন্দন! কাব্যের জন্য নহে, যেমন পুরুষ-কবির বেলায় খাটে । নারীর 
মুখে নারীর স্তাবকতা পৃথিবী' এখনো শুনে নাই । যাহা হউক, আমি মৃন্ময়ীর 
ব্যবহারে ও আচরণে কোথাও মালিন্ত লক্ষ্য কবি নাই। ইহা সতা, সে 
আমার সাহায্য চাহিয়াছে কিন্তু কিছু দাবি করে নাই; আমার মানবতার 
প্রতি আবেদন জানাইয়াছে, কিন্তু ছলনার্‌ সঙ্কেতে অভিভূত করিতে চাহে নাই। 
“কবে তাহাদের কোন্‌ অন্যায়ের কথা মা মনে করিয়া আজিও তাহাদের তিবস্কার 
করিলেন, আমি কিন্ত ইহার সঙ্গত যুক্তি খজিয়া পাইলাম না। তাহাদের 
'অন্যায়টা চারিত্রিক অথবা বৈষয়িক তাহা আমার অজ্ঞাত । যদি চারিত্রিক হয় 
তবে আমার অপেক্ষাও তাহারা হীন একথা স্বীকার করিতে আমার অস্কারে 
বাধে; যদি বৈনগ্িক, তবে তাহাদের অপেক্ষা আমি কম জুয়াচোর ইহ 
ক্বীকার করিবার আগে আমি অহিফেন সেবন করিয়। আত্মভত্যা করিব । নিজের 
অধঃপতন লইয়া আমি গৌরব করি না বটে, কিন্তু মৃন্ময়ীবা আমা অপেক্ষা ৪ 
অধঃপতিত-_একথা আমি মানি না। 

যাহা মনে করিয়াছিলাম তাহা হইল 'না। মায়ের রুদ্রাণী মুত্তির উগ্রকণ্ঠ 
আমাঁকে যেন মৃন্সয়ীদের বড়ীর দিকেই ঠেলিয়া লইয়া চলিল। আকাশ 
_ পরিষণার হইয়াছে, গ্রীম্মকালের বরাত দশটা এমন কিছু গভীর রাত নহে, 
'আমি আবার গোয়াবাগান হইতে যাঁইবার জন্য ট্রামে উঠিয়া বসিলাম ৷ আজকার 
রাতটা আমি চরিত্র রক্ষা করিব। ইহা দেখিব, আমার এই সংযমের বিনিময়ে 
আমি কতটুকু শ্রেষ্ঠতর বস্ত আদায় করিতে পারিব। ' মৃন্ময়ীর ম! মরিতেছে, 
আর তাহার মাথার উপর কেহ থাকিতেছে না । যে ছুইটা অজ্জাতকুলশীল 
যুবককে দেখিয়া আসিয়াছি তাহাদের পুলিশের ভয় দেখাইয়া অবশ্ঠই তাড়াইতে 
পারিব,_-তাহার পরৈ মৃন্ময়ী আমার কধল হইতে আর যাইবে কোথায়? 


হু 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বাল্যকালে আমি তাহার খেলার সাথী ছিলাম, কিশোরকালে তাহার শিবের 
গাজনের সঙ্গী ছিলাম, যৌবনকালে যদি মাসখানেকের জন্য তাহার প্রিয়তন্ণ 
না! হইতে পারিলাম, তবে আজ এই রাত্রে কোমর বাধিয় তাহাকে বিপদ হইতে 
উদ্ধার কর্সিতে যাইতেছি কোন নির্ব,দ্বিতায়? মা মরিলে আজ রাত্রে সে 
কাদিবে, কাল রাত্রে আমার সহিত দাজিলিং যাইতে পাইয়া হাসিবে, কারণ 
আমার মনে হয় স্বামী ও সন্তান ছাড়া আর কাহারও মৃত্যু স্ত্রীলোকের মনে. 
গভীর রেখা-পাত করে না। মায়ের মৃত্যুতে যদি সে আলুথালু হইয়া কাদিবার 
চেষ্টা করে তবে আমি তাহাকে চোখ টিপিয়৷ ভালোবাসার লোভ দেখাইয়া 
থামাইব। এবং আড়ালে লইয়া গিয়৷ মৌখিক অভয় দান করিব। মুন্য়ীর, 
চোখে মুখে আমি একটি কৌমার্ময় শুচিতা৷ লক্ষ্য করিয়াছি, ভ্রষ্টবিত্রের যুবক 
হইয়া সেই বস্তটির প্রতি স্বাভাবিক প্রলোভন আমি অবহেলায় ত্যাগ করিতে 
পারিব না। মায়ের তিরঙ্কারই আমাকে যেন উৎসাহিত করিল। 

বাসাটা ভুলি নাই, সটান আসিয়া কলুটোলার পথে সে গলিট৷ বাহির 
কবিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলাম। অন্ধকারে হাতডাইয়। গলির-সবশেষ দরজাস্ক 
ঢুকিয়া সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিলাম। 

মৃত্যুর দৃশ্য ছুই চাবিবার আমি দেখিয়াছি, একবার দুর্বলতাবশতঃ কৰে 
জানি চোখে রুমালও চাপা দিয়াছিলাম, কিন্তু এখানে আসিয়া জীবন সম্বন্ধে 
নৃতন করিয়া আমাকে চিন্তা করিতে হইল। উপরে উঠিয়া ঘরের দরজায় 
আসিয়া ঈাড়াইলাম। ভিতরে আলে! তেমনিই জলিতেছে, ম্ৃক্ময়ী তেমনি 
নিবিকার নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে । আমাকে দেখিয়া বলিল, আসন্ন ॥ 
আপনার জন্তেই অপেক্ষ1! করছিলুম । 

রোগীর নিশ্চল অবস্থা দেখিয়! আমি প্রশ্ন করিলাম, এখন অবস্থা 
কেমন? 

মৃন্ম়ী কহিল, আপনি যাবার মিনিট দশেক পরেই মারা গেছেন। 
আপনাকে এই রাত্রে ভারি কষ্ট দিলুম, আমাকে ক্ষমা করবেন। 


২৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তাহার বলিবার সহজ ভঙ্গী দেখিয়া আমি স্তব্ধ-'ও নির্বাক হইয়! দাঁড়াইয়া 
পড়িলাম। কষ্ঠস্বরে তাহার এতটুকু কারুণ্য, এতটুকু অসহায়তা নাই। 
সন্তান হইয়া মায়ের মৃতদেহের কাছে এমন নিবিকার ভাবে কেহ বসিয়া 
থাকিতে পারে আমি কল্পনাও করিতে পারি না। অন্য দ্িকটাও আছে। 
€ক সংকাঁর করিবে, কে মড়া বহিয়া শ্মশানে লইয়া যাইবে, তাহার নিজের 
উপায় কি হইবে, আগামী কাল সকালে অভিভাবকহীন অবস্থায় সে কোথায় 
প্রাড়াইবে__এই সব চিন্তা সে করিতেছে কি না জানি না, কিন্তু তাহার 
মুখ দেখিয়া আমার মনে হইতে লাগিল, এ সব কিছুই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে 
না। তাহার শান্ত ও অবিচলিত ভাবের মধ্যে যেন একটা সুদূর কাঠিন্য ও 
রুক্ষতা আবিষ্কার করিতে পাবিলাম । 


ঘরের ভিতরে পা বাড়াইতে আমার যেন মন উঠিল না। কেবল গল 
বাড়াইয়া এক সময় প্রশ্ন করিলাম, সেই ছোক্র! দু'জন কোথায় গেল? 
' সুন্ময়ী উঠিয়া আসিল, বলিল, এ ঘরে লৌকজন আসবে, তাদের পক্ষে এখানে 
থাঁকা বিপজ্জনক । আঘি তাদের সরিয়ে দিয়েছি । 

ব্্ত হইয়া বল্লাম, সে কি, তোমার ত লোকজন কেউ নেই, আজকের 
বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে কেমন ক'রে? 

মৃন্ময়ী সহজ কে বলিল, বিপদ? মানুষ জন্মীলেই মরে, মা সকালে 
বেঁচেছিলেন এখন আর নেই--এটা আর এমন কি বিপদ, রাজেনবাবু 1 
এই ত' বিছানাতেই রয়েছেন, তবে প্রাণটা আর নেই__এই মাত্র! 

ডাকিনীর মুখের দিকে আমি চাহিলাম, তাহার মুখ দেখিয়া আমার 
ভয় করিতে লাগিল। নিকটে ও দূরে জনমানব কেহ নাই, তখনকার সেই 
ছাপাখানার শবটাও থামিয়া গেছে, বুষ্টিবাদল বন্ধ হইলেও পথে লোক-চলাচল 
আর নাই বলিলেও হয়,__-আর ভিতরে এক! এই ছুঃসাহমিকা মৃতদেহ পাহার 
দিয়া অপেক্ষা করিতেছে । মনে করিলাম, ত্রিশটা টাকা ও সোনার চুড়ি 
দুগাছা ইহার হাতে দিয়া আমি পলাইয়া ষাই, এই একটা অদ্ভূত আকশ্মিৰ 


২ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ঘটনার জালে জড়াইয়া ও বিপদে মাথা দিয়া আমার ঘৃরপাক খাইবার 
প্রয়োজন নাই, কিন্ত মৃন্ময়ীর টসটসে যৌবন ও গ্রীবাভঙ্গী দেখিয়া আমি পুনরায় 
লুন্ধ হইয়া উঠিলাম। বলিলাম, তা হলে এসব করবে কে? ---7 

মৃন্ময়ী বলিল, আপাতত আপনাকেই এসব করতে হবে। 

আমাকে ?- বিস্মিত হইয়! বলিলাম, কী বলছ তুমি, মীন? এসব ত আমার 
অভ্যাস নেই । আর তাছাড়া আমাকে এখুনি ফিরতে হবে । আর তাছাড়া 

মৃন্ময়ী গলার আওয়াজে যেন একটু জোর দিয়াই বলিল, আপন্ার সঙ্গে সন্ধ্যার 
সমর দেখা না হ'লে কি করতুম এখন আর ব্লতে পারিনে, কিন্তু দেখা বখন হয়ে 
গেল তখন আপনাকেই সব করতে হবে। 

তোমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ থাকলে আমি না হয় খবর দিতে পারতুম। 
--আমার কে পুনরায় প্রতিবাদ ফুটিল। 

আমার কেউ নেই ।_ স্বন্ময়ী বলিল | 

কিন্তু একা ত" সব করা যায় না, মৃন্ময়ী ? 

মুন্ময়ী বলিল, একাই সব করা যায়। আমি অপেক্ষা করি, আপনি গিয়ে 
সংকার সমিতিতে খবর দিন, তারা গাড়ী এনে নিয়ে যাবে । রাজেনবাবু, আপনি 
আর দ্রাড়াবেন না, বেরিয়ে পড়ুন । আপনি পুরুষ মানুষ, ভয় কি? 

সে যেন মামাকে ঠেলিয়া পিঁড়ি দিয়! নামাইয়া দিল। তাহার চেহারা 
দেখিয়| আমার প্রতিবাদ করিবার সাহস হইল না, এবং পলাইবাঁর চেষ্ঠা করিতে 
গিয়াও যেন পৌরুষে আঘাত লাঁগিল। মনে একটা সান্ত্রন। রহিল এই যে, 
আগামী কাল ইহাকে আমি আমার কবলে পাঁইব, ও ইহার অভিভাবকহীন 
অবস্থাটার স্থযোগ লইয়! কিছুকাল সর জীবন অতিবাহিত করিতে পারিব। 

ইহার পরে সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত না বলিলেও চলে। মৃন্য়ী আমাকে পুরুষ মান 
বলিয়াছে, স্থতরাৎ অনিচ্ছাসত্বেও কোনে! কাজ হইতে পিছাইতে পারিলাম না। 
রাত্রি বারোটার সময় গাড়ী আনিয়া মৃতদেহ শ্বশানে লইয়া গেলাম । মুন্সয়ী কার্দিল 
না, কোনো কাজেই পিছাইল না, কেবল যখন তাহার মাতাকে চিতার উপর 


হগ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


চড়ানে। হইল, .তখন তাহার কণ্ঠম্বরট1! একবার কাপিয়া উঠিল। বলিল, 
রাজেনবাবু, আর আমার কেউ বইল ন!। 

আমি তাহার দিকে একবার চাহিলাম। সত্য বলিব, ইতিমধ্যেই আমার 
একটা শ্মশান-বৈরাগ্য 'আসিয়াছিল । আমি যেন ক্ষণকালের জন্য তাহার গতি 
আমার ব্বরোচিত আসক্তি, তাহার রূপ, তাহার ঘৌধন, আমার স্বার্থপরতা ও 
চিত্ত 'মালিন্য-_সমস্তই জুলিয়। গেলাম। আগামী কাল প্রভাত হইতে এই 
তরুণীর জীবনে যে ঝটিকা ও সংগ্রাম ও সংঘধ সুরু হইবে, আমি যেন তাহার 
সেই দীর্ঘ ইতিহাসটা মানস চক্ষে দেখিতে পাইলাম । চিরদিন নিজের দিক 
হইতেই পৃথিবীকে বিচার করিয়াছি, আত্মপরতাকেই সকলের আগে স্থান 
দরিয়াছি এবং নিজের সুযোগ-কুবিধা ভিন্ন আর্‌ কাহারও সমস্তাকে কখনও বিচার 
করিয়া দেখিবার অবসর পাই নাই। কিন্তু আজ রাত্রিশেষের অন্ধকারে 
নদীতীর্বর্তী শ্মশানের চিতাগ্নির আভায় আমি যেন পলকের জন্য সমগ্র পৃথিবীর 
মুখের দিকে চাহিয়া চিন্তা! করিলাম, নিজের পাওন।-গপ্ডাই সবাগ্র গণ্য নয়, কিন্তু 
ভাগ্য-বিড়ধিত হতমান জীবনের নিরুপায় লাঞ্ছনা, যাহ। ছুঃখে ও ছুদশায় জর্জর, 
তাহার সমস্যা অনেক বড়। 

বলিলাম, স্বন্ময়ী, কেউ যার নেই তার পিছনেও একজন থাকে, তুমি 
সেইদিকে চোখ রেখো। 

মুন্ময়ী আমার কথার জবাব দিল না, কেবল নীরবে জলন্ত চিতার দিকে 
তাকাইয়া রহিল। যে-কথাট। আমি সহসা বলিয়! ফেলিলাম তাহার সম্যক্‌ অর্থ 
আমি নিজেও বুঝিলাম না । নিরুপায়ের পিছনে ঈশ্বর আছেন এমন আজগুবী 
কথা আমি বলিবার চেষ্টা কৰি নাই, তাহার পিছনে আমি আছি-_এমন বেয়াড়া 
ও দাস্রিত্ব-জ্ঞানহীন উক্তিও আমার মুখ দিয়া বাহির হইবে না, কিন্ত 
বৈরাগ্যের দ্বার! প্রভাবাঞ্ধিত হইয়! বোকার মতো এমন একটা মন্তব্য 
কৰিলাম যাহা তাহাকেও উৎসাহিত করিল না, নিজেও তাহার নিকট সুস্পষ্ট 
হইলাম না। 


২৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ভোরের দিকে পথে ঘাটে খন লোকজন জাগে নাই তথন মৃন্ময়ীকে বাসার 
কাছে পৌছিয়! দিয় আমি বাড়ী ফিরিয়াছিলাম। কথা ছিল, আমি মধ্যাহ্নে 
মাহারা্দি করিয়া তাহার নিকট অসিব, সে যেন ইতিমধ্যে কোথাও না গিয়া 
আমার জন্য অপেক্ষা করে। 

গতকাল তাহার সম্বন্ধে যেসকল স্থখ-কল্পনা করিয়াছি আজ তাহাতে যেন 
টল্লাস বোধ করিতে পারিলাম না । তাহার সহিত প্রণয় করিব এবং মাস- 
ধানেক পরে আখের ছিবড়ার ন্যায় তাহাকে পথের ধারে ফেলিয়। যাইব- আমার 
এই মনোভাব আমাকে যেন আর উৎসাহিত করিল না। এই ভাবিয়া আমার 
ভয় হইল বে, উহার সহিত মেলামেশ। করিতে গেলে আমি এমন ভাবে হয়ত 
সড়াইয়া পড়িব যে, সেই জাল ছিড়িয়া বাহির হওয়। কঠিন হইবে । আমি 
ববা্থপর ও লোভী সন্দেহ নাই, কিন্ত' আমার স্বার্থপরতা ও লোভ নি্রফ্ভাবে 
একজনের জীবনকে পদদলিত করিয়া সম্পূর্ণতা লাভ কবিবে ইহা! যেন অতিশয় 
গমান্ুযিকতা মনে হইতে লাগিল । আখের ছিবড়ার মতো তাহাকে ফেলিয়া দিলে 
নন কোথায় আশ্রম পাইবে, এই কথাটা মনে হইতেই আমি নিরুৎ্পাহ বোধ 
₹রিলাম। যাহার পিছনে স্থিতি-স্থাপকতা আছে অথব! সামান্য একটা শিকড় 
গাছে, তাহাকে লইর়। সাঁময়িক-ভাবে আনন্দ উপভোগ করা চলে, কিন্ত সৃম্ময়ীর 
কছুই না থাকার জন্য সে আমার নিকট একট! সমস্যা হইয়া দাঁড়াইবে, ইহাতে 
মামি একটু বিপন্ন বোঁধ করিলাম । অসচ্চরিত্রা স্ত্রীলোক আমার পক্ষে নিরাপদ, 
কাছেই টানি অথবা দূরে ফেলিয়া দিই, কিছুই যায় আসে না--এক ঘাটের জল 
(রাইলে অন্য ঘাটে গিয়া সে তৃষ্ণা নিবারণ করিবে, আমি মুক্তি পাইয়। বাচিব; 
কন্ত মুনময়ীর যদ্দি চরিত্রশুচিতা থাকে তবেই আমার পক্ষে বিপদ, কারণ স্ত্রীলোকের 
স্রম সম্বন্ধে দায়িত্ব-বোধ আসিলে প্রাণের আনন্দে আর স্বেচ্ছাচার করিয়া 
বড়াইতে পারিব না, সে আমার পক্ষে একটা প্রধান সমস্তা হইয়া ধাড়াইবে। 

তেমন সমস্তা যাহাতে না দেখা দেয় তাহারই চেষ্টা করিব। নীতিজ্ঞান 
নটনে থাকিলে এই ক্ষণস্থায়ী জীবন বনু রকমের আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইয়া 


৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


থাকিতে হয়-_বিংশ শতাবির সম্তান হইয়া এতখানি উদার আমি হইতে পারিব 
না। স্ৃতরাং মাছও ধরিব অথচ জলম্পর্শ করিব বাঁ_এইরপ স্থির করিয়! নির্জন 
মধ্যাহ্নকালে গা ঢাকা দিয়া আমি পুররায় মৃন্ময়ীর কুগ্ডে আসিয়া উপস্থিত হইলাম । 

উপরে উঠিয়া ঘরের দরজার কাছে আসিয়৷ দাঁড়াইলাম। মৃন্সয়ী জামাকাপড়, 
পরিয়! মেঝের উপরেই বসিয়া কি যেন লেখাপড়া করিতেছিল, মুখ তুলিয়া বলিল, 
আহ্বন, আপনার অপেক্ষাতেই রয়েছি । 

বলিলাম, ঘরের জিনিষপত্র গেল কোথায় ? 

মুন্ময়ী কহিল, সকাল বেলা লোক ডেকে এনে সব বিক্রি করেছি । আমার 
ত' আর কোনো দরকার রইলো! না। 

কিন্তু বাচতে গেলে সবই ত লাগবে, মুন্সী? তুমি যাচ্ছ কোথায়? 

ৃন্ময়ী আমার দিকে মুখ তুলিয়া কান হাসিল। বলিল, যেদিকে দু'চোখ 
যায়। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, ভেতরে আস্কুন ? 

বলিলাম, বসতে দেবার ত কিছুই বাখোনি, কোথায় বসবো? তুমি এমন 
একটা কাণ্ড করেছ যেটা৷ পুরুষ মানুষকেই মানায়, মেয়েদের পক্ষে বে-মানান। 

সেটা কি বলুন ত? 

বাগ করিয়া বলিলাম, যে দিকে দুচোখ যায়_-এ কথা বলা আমাদের 
পক্ষে সহজ, আমরা কৌপীন এটে মজুরী ক'রে দিন চালাতে পারি, কিন্ত 
তোমাদের পক্ষে এই বাহাছুরী সম্ভব নয়। 

ৃন্ময়ী কি যেন ভাবিতে লাগিল। মনে হইল আমার কথাটা সে গ্রাহই 
করে নাই, আমার মন্তব্যে তাহার কিছুই যায় আসে না। তাহাকে চুপ করিয়া 
থাকিতে দেখিয়া পুনরায় বলিলাম, তোমার এমন একটা লক্ষ্য হয়ত আছে যেটা 
তুমি আমার কাছে প্রকাশ করতে চাও না, কি বলো? 

ৃন্ময়ী পুনরার মৃদু হাসিল এবং যাহা আমি প্রত্যাশা করি নাই, সেই তিরস্কার 
সে সহজেই আমাকে করিয়া বসিল । বলিল, ঠিকই বলেছেন । আপনার 
কাছে আমার মনের কথা কেনই বা প্রকাশ করব ? 


১৬, 


বড়ের সঙ্কেত 


কেন করবে না ?__নিজের কে জোর দিলাম । 

স্ুম্পষ্ট চক্ষে সে আমার দিকে চাহিল। তাহার সেই নিঃসক্কোচ ও সহজ 
ষ্টির কাছে আমি যেন কিছুতেই মাথা তুলিয়া থাকিতে পারিলাম না। সে 
কহিল, আপনার সাহায্যের জন্য কাল থেকেই আমি উপকৃত, আপনার উপকার 
আমি মনে রাখবো । কিন্তু আপনার এই ছেলেমাঙ্ধী দাবি কেন? আপনার 
অন্ুরোধেই এতক্ষণ আমি বসেছিলুম । আমি কোথায় যাবো অথবা কি করবো, 
এ আপনি শুনতে চাইবেন না, বাজেনবাবু। 

সে যেন আরে। কি বলিতে যাইতেছিল, আমি পকেট হইতে তাহার দুইগাছ! 
চুড়ি ও পনেরোটি টাকা বাহির করির! তাহার নিকট বাখিপাম। সে কহিল, 
চুড়ি আপনি বিক্রি করেননি ? 

বলিলাম, না, সময় পাইনি । তিরিশ টাকা ছল, তার মধ্যে পনেরো! টাক 
তোমার মায়ের কাজে খরচ হয়েছে । তোমার চুড়ি নিয়ে বাও। 

তা হ'লে তিরিশ টাক1 আপনি আমাকে দান করলেন? আপনি তা হ'লে 
একজন মন্ত দাতা বলুন? 

ক্ষুণ্ন হইয়া বলিলাম, সামান্য টাকার জন্তে বিদ্রপ করে৷ না, ম্বনয়ী ? 

সামান্য ?মৃুন্ময়ী হাসিয়া বলিল, আপনার কাছে যেটা সামান্য, আমার 
কাছে সেট! এক মাসের খাই খরচ । আপনাদের মতন ধনী লোক দেশে আছে 
বলেই ত” আমাদের দ্রিন চলে! আচ্ছ!, এবার আপনার কাছে বিদায় নেবো» 
'বাজেনবাবু। 

বলিলাম, একটা কথার জবাব চাই, মীন । 

কি বলুন ? 

তোমার মায়ের "পরম শত্রু" আর পাষণ্ড বলে তুমি যাকে স্টেশনে আনতে 
গিয়েছিলে, নে কে? 

মৃন্যয়ী বলিল, ওটা মাটার তলায় চাপা পড়েছে, স্থতরাং আপনার প্রশ্নের 
উত্তর দেবো না । 


২৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পুরাতন উদ্বিগ্ন কষ্ঠে প্রশ্ন করিলাম, কোথায় গিয়ে থাকবে তুমি? 

সেকথা! আপনি জানতে চান্‌ কেন? ৃ্‌ 

বলিলাম, ছেলেবেলায় আমি তোমার শিবের গাজনের সঙ্গী ছিলুম পিই 
'অধিকারে জানতে চাই । 

মুন্থায়ী বলিল, সে অধিকার আপনার মা-বাবা নষ্ট করেছেন আমাদের ঘর 
জালিয়ে । এই বলিয়া সে বাহির হইয়া! আসিল । 

আমার যেন একটা ব্যাকুলত] জন্মিল। মনে হইল, সে চলিয়া! গেলে তাহার 
সহিত আমার অনেকখানি যাইবে । কম্পিত কণ্ঠে বলিলাম, তবে এক রাত্রির 
পরিচয়ের অধিকার নিয়ে জানতে চাইছি । জানতে চাইছি, মনুষ্যত্বের অধিকারে 
--বলো মুনুয়ী ! 

বড়লোকের মন্ত্ত্ব 1--এই বলিয়া হাসিতে হালিতে মুন্নী নীচে নামিয়! 
গগেল। আমি যেন ভয়ানক অপমান বোধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া দাড়াইয়া রহিলাম। 


তিন 


, স্্রীলোকের বিদ্ধপে সেদিন অপমান বৌধ করিয়া বাড়ী ফিরিবার পর কয়েক 
দিন কাটিয়! গিয়াছে । ক্ষত গভীর হইলেও ঘ! একদিন শুকায়, মানুষ আবার 
নিজের স্থব্ধিজনক পথ আবিষ্কার করিয়া লয়, ইহাই রীতি । মৃন্ময়ীর বিদ্রপের 
স্থৃতি ফিকা হইয়া আসিল, অপমান আর মনে রহিল না । কিন্তু এই কথাটা 
ভাবিয়া মনটা টন টন করিতে লাগিল, যে, অম্ঘলিতকৌমার্ধ একটি তরুণীকে 
হাতের মুঠায় পাইয়াও হারাইলাম। বড়লোক বলিয়া খোঁচা দিয়া গেল, 
বাল্যবন্ধত্বকে অস্বীকার করিল, একরাত্রি ধরিয়া তাহার অসময়ে উপকার করিলাম, 
তাহা সে ভূলিল, দানের কৃতজ্ঞতাকে গ্রাহ্থ করিল না,_এবং সর্বোপরি, এই যে 
আমার তরুণ বয়স, এই ষে আমার বিস্তৃত বক্ষপট ও বলিষ্ঠ বাহু--ইহাদেরও সে 
মুখ বাকাইয়া উপেক্ষা করিয়া চলিয়া গেল। সকল গুণের অধিকারী হইয়াও 


১৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমি তাহার ন্তায় একটা সমাজচ্যুতা অভিভাবকহীনা স্ত্রীলোকের নিকট ঠাই 
পাইলাম না, ইহা বিস্ময়ের বিষয়। তাহার এই অহঙ্কারের মূল ভিত্তি কোথায়, 
তাহা জানিতে ইচ্ছা করে। আমি তাহাকে অধঃপতনের পথে লইয়া গেলেও 
তাহার গৌরববোধ করা উচিত ; আমার বংশমর্াদা ও সামার্জিক প্রতিষঠার 
আভিজাত্য স্মরণ করিয়া সানন্দে আমার পায়ের তলায় তাহার প্রাণ দেওয়া কত'ব্য 
__কিস্ত কোন্‌ আম্মাভিমান তাহাকে এই সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত করিল, বুঝিলাম 
না। তবে কি পুরুষকে না পাইলেও মেয়েরা কাজ চালাইতে পারিবে? তবে 
কি মৃন্মকী অন্যের গ্রতি আসক্ত? 

স্ীলোকের রুচি ও স্বাতন্তরা বলিয়! কোনো পদাথ আছে, তাহা এই প্রথম 
আবিষ্কার করিলাম । তাহাদের ভিতরে কিছু নাই বলিয়াই উপবরটা অত সুন্দর, 
তাহাদের প্রাণের চেহারায় কোনো রং নাই বলিয়াই উপরটা অত মনোহর । 
পশুরাজ্যে স্্রীজাতির রূপ নাই ও পুরুষের বুদ্ধি নাই; প্রকৃতি নিজের কাজটা 
একরকম করিয়া সারিয়া লয়। কিন্তু মানবজাতির মধ্যে পুরুষের বুদ্ধি ও মক্তিফ 
থাকার জন্য প্রকৃতিদেবীর ব্ড় অস্থৃবিধা হইয়াছে । তিনি তাড়াতাড়ি নিজের 
ফাক ঢাকিবার জন্য মেয়েদের মাথায় রেশমের গোছার ন্ায় চুলের রাশ 
দিয়াছেন, গায়ের চামড়া ঢাকিয়াছেন অতি মন্যণ মখমলে, চোখের তৃষ্টিতে 
দিয়াছেন মধুরতম মিথ্যার ঈঙ্জিত, চরণ দুখানি করিয়াছেন কমল-পল্লব 7 এবং 
শরীরের অন্তান্ত স্থানে এমনই উপকরণ সাজাইয়। রাখিয়াছেন, যাহা পুরুষের 
মস্তি ও বুদ্ধিকে বিকৃত করিবার পক্ষে যথেষ্ট । কিন্তু ৃন্সয়ীর এই দস্ভ দেখিয়া 
আমার একটু ভাবান্তর ঘটিল। স্ত্রীলোক সম্বন্ধে এখন হইতে আমাকে নৃতন 
করিয়া চিন্তা করিতে হইবে, এই চিন্তাটাই আমার নিকট গীড়াদায়ক বোঁধ হইল ।. 
আমার প্রলোভনে সে প্রলুব্ধ হইবে এবং আমার ভালোবাসা পাইয়া সে ধন্য 
হইবে, ইহাই জানিতাম ? কিস্ত মৃন্ময়ীর স্পধ1 আমাকে চিস্থিত করিয়া তুলিল। 

ব্যাদ্বের কবল হইতে শিকার পলাইলে তাহার কিরূপ অবস্থ! হয় ?' 
নখর ফুলাইয়া, নিজের থাবা চাটিয়া, গোঁ গে করিয়া হিংশ্রভাবে পদচারণী 


২৯ 


বড়ের সঙ্কেত 


করিয়া বেড়ায় । মৃন্ময়ী পলাইবার পরে আমি বাড়ীর সহিত বিবাদ করিলাম, 
মাকে ধমক দিলাম, চাকর-বাকরকে খুব প্রহার করিলাম, নেশা করিয়! স্বেচ্ছাচার 
করিয়। বেড়াইলাম। এই ভাবে মনের দূষিত বাম্প খানিকটা নির্গত হইবার পর 
আমার চৈতন্য ফিরিল এবং কবির ভাষায়-_-“তাহারেও বাদ দিয়া দেখি বিশ্বতৃবন 
মন্ত ডাগর 1 আমি পুনরায় অন্য শিকারের সন্ধানে বেড়াইতে লাগিলাম। 

আজ কয়েকদিন হইল পিতৃদেব দিল্লী হইতে ফিরিয়া অসুখে পড়িয়াছেন। 
অস্খ তাহার নৃতন নহে, .অন্ুখটা বাধক্যের। এদিকে আমার দাজিলিং 
যাওয়া ঘটে নাই,পিতার অসুখের জন্যও বটে ও অসময়ে ব্যা আরম্ত 
হইয়াছে সে-কারণেও। সকাল হইতে সন্ধ্যা অবধি এলোপ্যারথী, হোমিওপাথী 
ও কবিরাজী মিলাইয়। পিতৃদেবের পেটের ভিতরটাঁকে একরূপ ওষধালয় 
বানাইয়া তৃলিতেছি। কিন্ত তাহার অস্থখ বাড়িতে লাগিল । 

একদিন বাবা আমাকে ডাকিলেন। কাছে গিয়া বসিলাম। তিনি 
বলিলেন, তোমার মায়ের কাছে শুনলুম সরোজিনীদের সঙ্গে তোমার দেখা 
হয়েছে, তারা এখন কোথায়? 

পিতার কৌতৃহলটা আমার কানে বাজিল? কিন্তু আত্মরক্ষার্থে তাড়াতাড়ি 
বলিলাম, হা?, সে একদিন দেখা হয়েছিল বটে, আর কোনো খবর রাখিনে। 
সরোজিনী ত” মারা গেছেন । 


বলে৷ কি? 

আজ্ঞে হ্যা, তার মৃত্যুর দিনেই মেয়ের সঙ্গে দেখা, আমার কাছে মেয়েটি 
'কিছু সাহাযা চেয়েছিল। 

বাবা বলিলেন, হ্যা শুনেছি সব। তাহলে সরোজিনী মারা গেল? অনেক 
দুঃখ পেয়েছে বটে। 


বলিলাম, আপনি ত তাদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, বাবা? 
মিথ্যে নয়। 
কেন দিলেন? 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমর! ছিলুম জমীদার, তারা প্রজা! । 

বলিলাম, তার! কিছু দোষ করেছিল? 

বাবা চুপ করিলেন। কিয়ংক্ষণ পরে বলিলেন, তোমার মায়ের হুকুম পালন 
করছিলুম । 

একটু প্রশ্রম্ন পাইয়া প্রশ্ন করিলাম, গরীবের ঘর জালাবার হুকুম ম! 
দিল কেন? র 

বাবা যেন কি ভাবিলেন, পরে কহিলেন, অপরাধ একটু ছিল বৈকি । তারা 
মাথা হেট করে থাকতে চায়নি, চেয়েছিল সমান সমান অধিকার ! দারিদ্রাটা 
ছিল তাদের অহঙ্কার, গরীব বলেই তাদের স্পর্ধা ছিল অনেক উচুতে। 
তাব। ভেঙেছে, কিন্তু মচকায়নি । 

আমি যেন সহদা নৃতন আলোয় পৃথিবীর দিকে চাহিলাম । সরোজিনীর 
মৃত্যুশয্যাটা চোখের উপর ভাস্লি। সেই মুখে মৃত্যুব পাখুরতার ছায়ায় চরম 
দারিদ্র্যের কোনও মহিমা ছিল কিনা প্রদীপের আলোয় সেই অস্পষ্ট দৃষ্থয 
আমার মনে পড়িল না। লোভে ও আত্মপরতায় আমি যখন জরজর হইয়া 
মৃন্ময়ীর দিকে চাহিয়াছিলাম, তখন তাহার আচরণ ও ভঙ্গীতে উন্নত রুচির দীপ্তি 
ফুটিয়া উঠিয়াছিল কিনা তাহাও এখন আর স্মরণ করিতে পারি না। তবু মনে 
মনে সেই দিনকার সমস্তটা ভাবিয়া আমার ন্ায় মাংসলোভীও লজ্জায় মাথা 
নত করিল। ভাবিলাম, আমার কৌশল-কুটিল নীচতা ও কুৎসিত লোভ হয়ত 
মুন্ময়ী মৃত্যই ধরিয়া ফেলিয়াছে, হয়ত আমার হৃদয়হীনতার দৈন্য ও কদর্ষত! 
তাহার নিকটে আর চাঁপা নাই । 

বলিলাম, মা'র কাছে আমি অন্য কথা শুনেছিলুম, বাবা । 

তিনি বলিলেন,তোমার্‌ মা কখনও চরিত্রের অপরাধ ক্ষমা করেন না,রাজেন । 

নিজের চরিত্রটা স্মরণ করিয়া আমি একটু ভয় পাইয়া চুপ করিয়া গেলাম । 
কথা বাড়াইতে সাহস হুইল না। তিনি বলিলেন, মেয়েটি এতদিনে ত" বড় 
হয়েছে । বোধ-হয় বিয়ে হয়নি, কি বলো ? 


৪১ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ঠিক বলতে পারিনে । 

বোধ হয় হয়নি, কারণ নিন্দেটা ওদের পেছনে কুকুরের মতন ছিল কিনা। 

বলিলাম, নিন্দেটা ত' মিথ্যে নয়, বাবা। 

বাবা বলিলেন, অনেক নিন্দেরও আবার মহিম। আছে, বাজেন | 

তবে আপনি নিজের হাতে ঘর জালাতে গেলেন কেন? 

তাদের ঘর জলেছিল, তাই তোমার মায়ের ঘর রক্ষা হয়েছে । অবশ্য 
ক্ষতিপূরণ আমি করবার চেষ্ট। করেছি । 

বলিলাম, বুঝতে পারলুম না, বাবা । 

এব বেশি আর কিছু বোঝবার নেই । 


বাবাকে ওুঁধধ খাওয়াইয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলাম | মুন্ময়ীর শেষ 
মন্তব্যটা আমার কানে আবার যেন নৃতন করিয়া বাজিল, ব্ডুলোকের আবার 
মনুষ্যত্ব ! বাল্যকালে আমাদের হাতে তারা মার খাইয়াছে, ধনী ও দরিজ্রেরে 
ভিতরকার সম্পর্কটাঁকে বিষাক্ত করিয়াই ভাবিয়া রাখিয়াছে, যতদিন মুন্ময়ী 
বাঁচিবে ততদিনহই সে এই কথাটা ঘোষণা করিয়। বেড়াইবে যে, যাহার! ধনী 
তাহাদের খেয়াল আছে, মেজাজ আছে, কিন্তু মন্য্যত্ব নাই । সংস্কার স্বভাবে 
ধাড়াইয়াছে, স্থৃতরা২ আমার আচরণে সে হয়ত খেয়াল ও লোভকেই লক্ষ্য 
করিয়াছে, কিন্ত প্রাণের স্পর্শ খুজিয়। পায় নাই । 

আমার মনোবিকার আমি সংযত করিতে পারিলম না। আলমারীর 
বইগুলির দিকে চাহিয়া ভাবিলাম, উহারা যেন অতীতকালের শত সহশ্র অন্যায় 
ও উৎপীড়নের ইতিহাস বুকে লইয়া! মুখ বুজিয়া আছে । একট! অন্ধ, অবরুদ্ধ, 
নিগুঢ় প্রশ্ন যেন ওই গ্রন্থগুলি হইতে বাহির*হইয়া আমারা চারিপাশে বীভৎস 
মুক্তি লইয়া দীড়াইল । আমার নিজ জীবনের চেহারাটা একটা যেন 
বিলোল লালসা ও সম্ভোগবাসনার পুগ্তীভৃত স্তপ। ক্ষুধার খাদ্য যোগাইয়া 
ক্ষধাকেই জাগাইয়াছি, প্রবৃত্তি ও ছুরন্তপনার তরঙ্গে ভাসিয়া অকুণঠ আত্মপরতাঁকে 
প্রাধান্য দিয়া আমি যেখানে আসিয়া পৌছিয়াছি তাহা! আমারই একটা নিজস্ব 


৩২ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


জগৎ, তাহার হালচাল আমিই জানি, আর কাহারও সহিত না মিলিলেও 
আমি একটা বিশেষ আনন্দের মধ্যে বীচিয়া থাকি । কিন্তু আজ পিতামাতার 
অন্যায়ের গুরুভার সহসা উৎক্ষিপ্ত হইয়া আসিয়া ধেন আমার উপরেই চাপিয়। 
বাঁসল। আমার বাল্যকালে যাহা আমার অজ্ঞানে ঘটিয়াছিল, যাহা আমার 
স্মৃতির চতুঃসীমার মধ্যে কোনও দাগ কাঁটয়া রাখে নাই, আজ যেন কবরের 
মাট ফুডিঘা সেই ছুক্ষমেদ কলঙ্কট। বাহির হইয়া ভয় দেখাইতে লাগিল। 
শিতার আলাপের মপ্যে আমি সন্তোষজনক কৈঞ্িরৎ খুগ্রিয়। পাই নাই, শুধু 
পাইলাম একটা স্বেচ্ছারুত বর্বর অহেতুক উত্পীড়নেধ কাঠিনী-ধাশার কোন 
চম্পষ্ট যুক্তি নাই, নীতি নাই, প্রয়োজন নাই । 

কলিকাতা শহরে আমি তাহাকে কোথায় খুজিয়! বাহির করিব? যাহাদ্ 
জীবন ও স্থিতির মূল আমার। নষ্ট করিয়া পথে ব্সাইরাছি, তাহারা পথে পথেই 
লস! বীধিয়াছে- আজও সেই মেয়ে কলিকাতার শাখাপ্রশাখা-বহুল পথের রহস্যে 
ডালিয়া গিয়াছে, আমি কোথায় গিয়!। তাহার সন্ধান করিব? কোন? চিস্ক, 
প্রাণের কোনও নিশানা, ব্্তার পঞ্কানও আঁভাস--এমন কিছুই নাই 
ধাভার রেখা অনুসরণ কিয়! মুন্ময়ীকে গিরা গ্রেপ্তার কিব। আর কিছু 
নয়, কেবল এই কথাটা জানাইয়! দিতে বাসনা হইল, আমি নিজে 
লোভী ও আঁত্সপর হইতে পারি, কিন্ত তোমাদের উপর উৎপীড়ন যাহারা 
করিয়াছে আমি তাহাদের পুত্র হইলেও এই আদিম বর্বরতা আমি সমর্থন 
কৰিব ন।। 

পৃথিবীতে যাহারা চিন্নকাল ধনী বলিয়! পরিচিত হয়, তাহারা চিরকাল 
পবিয়াই গরীবের বুকের উপর দিয়া তাহাদের খেয়াল ও স্বেচ্ডাচাবরের বুথ 
চালাইয়া আসিয়াছে, কিন্ত আমিও যে তাহাদেরই একজন প্রতিনিধি, মৃন্ময়ী এই 
কথাটা জানিয়া গেল,_কি উপায়ে ইহার প্রতিবিধান করিব? তাহার ম্যায় 
তরুণী আমি অনেক দেখিব, অনেক কাল ধরিয়া অনেককেই ভালবাসার দিক্‌ 
হইতে , প্রতারিত করিব, প্রয়োজন হইলে তাহাদের পরিচ্ছন্ন জীবনকে চূর্ণবিচুর্ণ 


৩৩ 


বড়ের সঙ্কেত 


করিয়া দিতেও পশ্চাপদ হইব না, কিন্তু এই অপবাদ কিছুতেই সহা করিব না 
যে, বড়লোক মাত্রই মন্তম্তত্্হীন, অহ্তক অত্যাচার করাই তাহাদের পেশা 
গরীবের অক্ষমতার সুযোগ লইয়া ঘর জালাইয়া দেওয়াতেই তাহাদের 
আনন্দ। 

' পিতার রোগের দুভাবন! ও আমার এই মনোঁবিকার লইয়া আমি যখন 
বিক্ষুব্ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতে ছিলাম, তখন একদিন সহসা পটপরিবর্তন 
ঘটিল। 

সন্ধ্যার সময়ে কোনও কালেই বাড়ীতে ঢুকি না, ইহা আমার অভ্যাস নাই। 
চরিত্রকে গোপন রাখিম্বা ও কৈিয়ৎ বাচাইয়া অনেক বাত্রেই বাড়ী আসিয়া 
পৌছাই। কিন্ত পিতদেবতার অসুখের জন্য চরিত্র রক্ষা করিয়! সেদিন সন্ধার 
সময়ে বাড়ী ঢুকিতেছিলাম, দেখিলাম একটি যুবক আমার জন্য অপেক্ষা 
করিতেছে । কিছু নেশা করিয়াছিলাম, মেই কারণে চোখ মুখের চেভাব। সহজ 
ছিল না, প্রাণের ভিভরে কিছু রাজসিক উল্লাস সঞ্চিত হইয়াছিল । 

ছোকর! আমাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। নমস্কার করিয়া কিল, 
আপনার জন্যই অপেক্ষ। করেছিলাম । 


কে আপনি? 
আমার নাম শ্যামাকান্ত ভট্টশালী । 
কি চাই বলুন? 


আপনাকে আমার সঙ্গে একটু ঘেতে হবে। 

চোখ রগড়াইয়া মুখের গন্ধ চাপিয়া তাহার আপাদ-মন্তক লক্ষ্য করিলাম। 
পরে বলিলাম, কোথা থেকে আসছেন আপনি ? কোথায় যাবো ? 

শ্যামাকান্থ কহিল, আমাকে চিনতে পারলেন না? 

বলিলাম, সম্পূর্ণ অপরিচিত আপনি । 

সে কহিল, হারিকেনের আলোয় দেখেছিলেন, ইলেক্টিকের আলোয় তাই 
মনে পড়ছে না। 


৩৪ 


বাড়ের সঙ্কেত 


বলিলাম, পৃরজন্মেও আপনাকে আমি দেখিনি । 
( ছোকরা আমার কথায় হাসিমুখে বলিল, সরোজিনী দেবীর মৃত্যুর দিনে 
মর ঘরে ছিলুম, আপনি দেখেন নি? 

৪১ শ্তরি ! কি চাই আপনার ? 

দিদি একবার আপনাকে ডাকছেন । 

ছলনাময় বৈরাগ্য প্রকাশ করিয়|। কহিলাম, দিদি কে? 

মুন্ময়ী | 

পুনরায় শ্যামাকান্তের মাখা হইতে পা অবধি লক্ষ্য করিলাম । বলিলাম, 
তিনি কি আপনার সহোদর ভগ্মী। 

আজে ন।। 

'তবে কি অতি-আধুনিক দিদি ? 

কথাট! বোধ হন শ্যামাকান্ত বুঝিল না, বলিল, যাঁদ একটু তাড়াতাড়ি 
আসেন ত' ভাল হয়, তিনি বাশ্তায় অপেক্ষা করছেন | 

ভিতরে ভিতরে অসীম উল্লাস বোধ করিলাম, বাহিরে গান্তীয রক্ষ! করিয়। 
কৃহিলাম, কি দরকার আপনি জানেন ? 

আমি ঠিক জানিনে, ভার কাছেই শুনবেন । 

তবে একটু অপেক্ষা করুন, আসছি-বলিয়। আমি ভিতরে গেলাম । 
উপরের ঘরে গিয়া আয়নার কাছে দাড়াইয়া চুল কিরাইলাম | শরীরটা ঠিক 
নিজের আয়ত্তে নাই, মাথার ভিতরট। একটু মত্ত হইয়া উঠিয়াছে। বলা বাহুল্য, 
মন্সয়ীর পূর্ব আচরণ দেখিয়া একটু সম্বম করিয়াছি, এইভাবে তাহার নিকট 
গিয়া দাড়াইতে কেমন যেন ভরসা পাইলাম না। কিন্ত এখন আর উপায় নাই, 
ঘাহাকে সমস্ত প্রাণ দিয় কামন| করিরাছি, সে দরজায় আপিরা উপস্থিত। 
পৈতৃক দু্ষমের প্রায়শ্চিত্ত না করিতে পারি, কিন্তু পিতামাতার হইয়া অবশ্যই 
ক্ষমা! চাহিতে পারিব। তাহার পর তাহাকে ভালবাসিয়৷ অতীত স্মতি যন 
হইতে মুছিয়৷ দিতে পারিব । 


৩৫ 


ঝড়েবু সঙ্কেত 


কয়েকটা এলাচ মুখে পুরিরা নীচে নামিয়া আসিলাম। শ্যামাকান্ত বাহিরে 
ঈাড়াইয়াছিল, তাহাকে সঙ্গে লইয়! পথে বাহির হইয়া পড়িলাম | 

গোয়াবাগান হইতে বাহির হইয়া বীডন ট্রাট দরিয়া আসিয়া হেচুয়ার 
কোণে উপস্থিত হইলাম । দেখিলাম, মুন্মরী সেখানে দাড়াইয়। এদিকে 
ওদিকে লক্ষ্য করিতেছে । আমি কাছে গির্া দাঁড়াইলাম। সে নমস্কার 
করিল না, অভ্যর্থনা জানাইল না, কেবল শ্যাঞ্াকান্তকে বলিল, 
তুমি আর দ্রাড়িয়ো নাঁ নীরেন, চলে যাও আন। ছুই পরমা দিন্‌ 
তঞ্গকে? 

আমি স্তত্তিত হইয়া পকেট হইতে দুই আনা বাহির করিরা দিলাম । 
শ্টামাকান্ত চলিয়া গেল। তারপর বলিলাম, এ যেন একটা ভেল্কি। এ ষে 
বললে ওর নাম শ্যামাকান্ত ভট্টশালী £ 

মুন্মরী হাসিমুখে বলিল, শিখিয়ে দিয়েছিলুম । 

বলিলাম, তোমাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে দেখছি কোন্‌ দিন আমিও পুলিশে 
ধরা পড়বো । 

ভয় নেই, পুলিশ মানুষ চেনে । আহন্থন এদিকে যাই । 

চলিতে চলিতে বপিলাম, হঠাৎ এই মন্তঘ্ৃত্বহীন বড়লোকটিকে ম্মরণ করলে 
কেন মৃন্ময়ি ? 

বড়লোককে ম্মরণ না করলে আমারা যাই কোথা ? 

ঠিকানা জানলে কি ক'রে ? 

আপনাদের ঠিকানা ছোটবেলা থেকেই জানি । 

আমি সবিম্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিলাম, সে পুনরায় কহিল, আপনার 
বাবার ত খুব অস্থখ, নয়? 

বলিলাম, কেমন ক'রে জানলে ? 

মৃন্ময়ী হাদিল। বলিল, আপনি আজ বিকেলে ধমতিলার হোটেলে ঢুকে- 
ছিলেন কেন? 


৩৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


'আমি ভয় পাইয়া মাথা নীচু করিলাম । মৃন্ময়ী চলিতে চলিতে বলিল, 
শ্যামাকাস্ত ভট্রশালী আর হরিহর মোদককে রেখেছি আপনার পেছনে পেছনে । 
বলিলাম, তোমার কি উদ্দেশ, মুন্ময়ি ? 
সত্যি বল্ব?- মৃন্মরী বলিল, আপনাকে এই নীতি শিক্ষা দেওয়া যে, বড় 
লোকের ছেলে বলেই টাকা নষ্ট করার অধিকার আপনার নেই । 
এইবার হাসিলাম। বলিলাম, এই কথা শোনাবার জন্য বুঝি এত দূর 


হ্যা, আজ সারাদিনে অন্কত দশ মাইল হেটেছি, দু'দিন আমাদের অন্ন 
জোটেনি, কারণ পয়লা নেই | 

বলিলাম, তাহলে বড়লোকেন মন্তযান্ব তোমরা তখনই স্বীকার করতে 
পাবো, যখন তারা টাকা দ্রিতে পাবে ? 

মুন্মরী বলিল, না, রাজেনবান্‌। এন্ুযাত্ব তাদের কোনোদিনই নেই-নেই 
ন্খশপরম্পরার। আমব। তাদের সম্ত্যত্বের শিক্ষা দিয়ে সম্মান-মূল্য আদায় 
কৰি। 

কে তোমরা ? 

আমারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়মকত1 | 

বগিলাম, কিন্তু নিধিনাম সর্দারদের ঢাল তরোয়াল কই? 

আছে, যথাসময়ে আপনাদের ঘাডে পড়বে-দ্লির। মৃন্সয়। হাসিল। 

এই বুঝি তোমাদের বিপ্রবের আদর্শ » আমাকে ডেকে এনে এই কথাই 
গচার করতে চাও ? 

না, মৃন্ময়ী বলিল, তান্র চেয়ে নড কাঁজ আপনাকে দেবে । 

যথা? 

স্বার্থত্।গের মহৎ ব্রত 

আমি চলিতে চলিতে মুন্ময়ীর দ্রিকে এইবার একবার ভাল করিয়। চাহিলাম। 
সত্য বলিব, মাতৃবিয়োগের শোকে এ সেই সেদিনকার গভীর দুশ্চিন্তার 


৩৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


সুগভীর কালো ছায়া তাহার মুখের উপর হইতে সরিয়া গিয়াছে । সারাদিনের 
পথশ্রম ও ক্রিষ্ঠতা তাহার টসটসে তরুণ মুখশ্রীকে যেন সুন্দর করিয়াছে । 
ভাঙা চুলের গোছ। তাহার মুখে চোখে ; আভরণ কোথাও কিছু নাই ; সামান্য 
জামী, সামান্য শাড়ী, কিন্তু প্রচুর স্বাস্থ্যের উপকরণ সর্বাঙ্গে থবে থরে সাজানো । 
আমি মনে মনে লুন্ধ হইয়। উঠিলাম ! আশান্বিত হইলাম । 

মূন্ময়ী কহিল, কি, চুপ করে রঈলেন যে? 

ভাবছি ছোটবেলাকার কথা, ভুমি সেই শিবের গাক্তন গাওয়া মেয়ে, এখন 
বিপ্রবীদলের দিদি । একটা কথ| কিন্থ আমার জানতে ইচ্ছে কবে, মীন্ত | 

বলুন? 

তোমাকে এমন বোকা বানালে কে? 

আপনাদের মতন বড়লোকেন্া । 

কিন্তু তাঁদের ওপর রাগ ক'রে এমন জীবনটা নষ্ট করব ? 

মুনয়ী প্রশ্ন করিল, নষ্ট আপনি কাকে বলেন? 

লুব্,, উজ্জল, একাগ্র দ্টিততি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলাম, এই সবই কি 
তোমার কাজ' 

আমার কণ্ঠে বোধ হয় মধু-র আস্বাদ ছিল; পথের নির্জনতা হরত আমাকে 
অল্পে অল্পে মোহগ্রস্ত করিতেছিল। রাত্রির কলিকাতার পথের আলোছায়। 
মৃন্ময়ীর ললাটে, গ্রীবায়, বক্ষে কী যে মায়া বুলাইল তাহা বলিতে পাবরিব না। 
আমি কেবল মাত্র একটি ইঙ্গিতের অপেক্ষা করিতেছিলাম, এবং সেটি পাইলেই 
শ্যেন্পক্ষীর ন্যায় তাহাকে তুলিয়া লইরা নিরুদ্দেশ শৃন্যে এমন ভাসিয়! যাইতাম 
যে, পিতার অস্থুখ, আমার কতব্য, বাড়ী ফিরিবাত কথা, মৃন্মরীর পরিণাম, 
কিছুই চিস্তা করিতাম না। | 

নিজের কে পুনরায় মধু ঢালিয়া বলিলাম মুন্ময়ি, এ তোমার ঠিক পথ নয়, 
তা তুমি জানে? 

মৃন্ময়ীর নীরবতা! সহসা বিদীর্ণ হইল। সে একটু সরিয়া গিয়া বলিল, 


৩৮ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


রাঁজেনবাবু, আপনার নিজের পথটা কি? নেশায় টলটল করছেন, একজন 
মেয়ে এসেছে সাহায্য চাইতে, তাকে কি ভাবে অপমান করবেন তারই 
ফন্দি আটছেন মনে যনে ; আপনার বাবার অত বড় অস্থখ, সেদিকে আপনার 
ভ্রাক্ষেপ নেই ; আমরা উপবাস ক'রে রয়েছি দু'দিন, আপনি গ্রাহা করলেন না__ 

আমি থমকিয়া ঈাড়াইলাম। 

মৃন্ময়ী পুনরায় কহিল, আমি এলুম আপনার কাছে ভিক্ষে চাইতে, মিনতি 
জানাতে; এলুম আমার ছোট ভাইবোনদের অন্নবন্থ চেয়ে শিতেআর 
আপনি আমাকে পথ ভুলিয়ে দিতে চান্‌। আপনার পথট] কি এই ? 

আমার নেশ! কাটিয়া গেল, পুনরায় ধীরে ধীবে চলিতে চলিতে বলিলাম, 
“দশে এত বড়লোক থাকতে আমার মতন লোকের কাছে সাহাযা চাওয়ার 
হস্ত কি? 

রহস্য কিছু নয় ।- মুন্মরী বপিল, টাকা অপব্যয় বাবা করে, তারা সম্ায়ও 
কিছু কনে বৈকি। আপনি ত রুপণ নন্‌। 

একখানা খালি ফীটন্‌ গাড়ী দেখিম্না ডাকিলাম। মৃন্ময়ীকে বলিলাম, 
ওঠো। 

ইতস্ততঃ করিয়া সে বলিল, অনেক ভাড়া নেবে যে? 

ত| হোক, এসো। 

সে উঠিয়া বসিল। আমি তাহার পাশে ব্সিলাম। সে কহিল, এ 
সব ছাই খান কেন? এলাচের গন্ধে আপনার মুখের ছুর্ন্ধ ঢাকা 
পড়েনি । 

বলিলাম, আর লজ্জা দিয়ে! না, কোন্‌ দিকে যাঁবে ব'লে দাও । 

মূন্ময়ী কহিল, একটা সর্তে কিন্ত আপনার সঙ্গে গাড়ীতে উলুম ব'লে 
রাখছি । 

সর্তটা কি। 

আমাকে অনেক টাকা দেবেন । 


৩৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


অনেক টাক1 তোমার কি হবে? 

অনেক দরকার । 

আমার স্বার্থ ? 

মুন্মযী বলিল, যে-টাকা আপনি জুয়া খেলেন, যে-টাকা আপনি সিনেমা 
আর থিয়েটারের গ্রীণরুমে খরচ করেন, যে টাকা নেশার দেন, সেই টাকাটা 
দিন দরিদ্রদের | 

বলিলাম, দরিদ্রদের? পয়ব্রিশ কোটর জন্যে নিজের আনন্দ মাটি করব? 

আপনার জীবনের লক্ষ্য কি? 

আমার জীবনের লক্ষ্য এই নয় যে, জনকয়েক অক্ষম বেকার ভবঘুরের জন্যে 
সর্বস্বান্ত হবো ! 

মুন্সীর গলার আওয়াজ যেন একটু ভারি হইয়া উঠিল। বলিল, আর যারা 
কোনো ভাল কাজের জন্তে জীবন পাত করে, তাদের জন্কে একটু স্বাথত্যাগ 
করা যায় ন|? 

ভাল কাজ ?- হাসিয়া উঠিলাম,_-এর কি কোনো বীধা-ধরা হিসাব আছে? - 
ভাল কাঙ্ করার চেয়ে ভাল ক'রে শ্াচাটা অনেক বেশি দাষি, মুন্ময়ি। এই 
ধরে! তোমার জীবন, তুমি কল্যাণ ক'রে গেলে পরের জন্য, তোমার দিকে 
চাইলে কে? তুমি পেলে যশ, পেলে প্রতিষ্ঠা, পেলে হাততালি-_কিন্তু বুকের 
ভেতরকার মরুভূমি হাহা করে ত” জলতেই থাকলো । বড় আদর্শের জন্যে 
তুমি সারাজীবন ধ'রে তিলে তিলে-_ 

আমি বোধ করি আরও বক্তৃতা দিতাম, কিন্তু মৃন্ময়ী গাঁড়োয়ানকে বলিয়! 
গাড়ী থামাইল। বলিল, আস্ন, আমাকে কিছু বাজার ক'রে দেবেন। আঃ, 
কী বকৃতেই পারেন আপনি । 

তাহার সেই অদৃশ্য অপোগণ্ড সখের ভাইগুলার উপর অপীম বিরক্তি ও 
আক্রোশ লইয়া গাড়ী হইতে নামিলাম এবং আধঘণ্টা ধরিয়া কয়েকটা টাকা 
খরচ করির! জীবনেও যাহা করি নাই, সেই দোঁকান-বাজার ঘাড়ে করিরা 


8৩ 


গাড়ীতে চাপাইয়া আবার গাড়োয়ানকে চালাইতে বলিলাম। গাড়ী 
দক্ষিণ দিকে চলিতে লাগিল, আমি মেঘমলিন মুখে গুম হইয়া বসিয়! রহিঙ্গাম । 
আসল প্রাপ্তির কথাটা! এখনও চাঁপ। পড়িয়া আছে ভাবির বাগ হইতে লাগিল । 
স্ীলোকের অন্ুগ্রহ্পাভের জন্য জীবনে অনেক সহা করিয়াছি, ইহাও সহা হইবে। 
দেখিতেছি ইহার শাখ|-প্রশাথা অনেক দূর অবর্ধি বিস্তৃত, সমস্ত শিকড়গুলি একে 
একে উতৎপাটন করিতে কিছু ধিলপ্ধ ঘটতে পারে: ধৈধ হারাইলে চলিবে না। 
হই দ্রিক হইতে দুইট। অন্বিধা আমাকে সংযত করিয়া রাখিয়াছে। প্রথমতঃ 
মেয়েটার সহিত আমার আবাল পরিচয়, অর্থাৎ অসভ্যত। প্রকাঁশ করিতে একটু 
বাধে; দ্বিতীয়তঃ, ভাল ব্ুকম লেখাপড়া! জানে, চি্তদৌবধলোর অদ্ধিসন্ধিগুল! 
বড় তাড়াতাড়ি ধবিয়া ফেলে; পাক পাকা কথা বলে। মিষ্ট করিয়া ছু'কথায় 
ভুলাইয়া প্রশ্রয় পাইবার উপায় নাই। টাকাপয়সাগডলা কোন্‌ অতলে 
তলাইভেছে কে জানে! 

আমি তাহাকে পথ ভুলাইতে শি! নিজে পথ ভুপিয়াছিলাম, কিন্ত ৃস্মরী পথ 
ভুল করে নাই। আমার চোখে মুখে যে-পরিমাণ আবেশ-পুলক সঞ্চারিত হইয়া- 
ছিল তাহার ছিল মেই পরিমাণ উৎকগা। আমার চোখ ছিল তাহার প্রতি, 
তাহার দৃষ্টি ছিল পথ ফুরাইবার দিকে । এতগুলি কথা এতক্ষণ ধরিয়। যে তাহাকে 
বলিলাম, তাহ| যে কেবল তাহার মনে কোনে। আচড় কাটে নাই তাহাই নহে, 
সে গ্রাহই করে নাই। স্বপু পরাজিত এবং উপেক্ষিত নহে, আমি যেন পুনরায় 
অপমানিত ধোধ করিলাম । 

এক সময়ে সে গাড়ী থামাইল । বলিল, এইখানে নামতে হবে। 

এতক্ষণে চমক ভাঙিল। পল্লীটার দিকে চাহিয়া সহসা ভয় পাইলাম । 
চারিদিকে বক্তি, ভদ্রসমাজ কোথাও নাই | কুলী, মজুর, কলকারখাঁন, বিড়ির 
দোকান, পতিতালয়, বাজার এখং চারিদিকে কুৎসিত হট্রগোল। বলিলাম, 
কোথায় থাক তোমরা ? 

এই সামনের গলিতে ।- মুন্সী পিছন ফিরিয়া! দেখাইল । 


৪১ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


অন্ধকার গলিটার দ্বিকে চাহিয়! কিছুই বুঝিলাম না, রেবল বুঝিলাম সেই 
কুড়ঙ্গপথে জন্ত-জানোয়ারের আনাগোনাই বেশি মানায় । মুন্সয়ী সহিপকে দিয়া 
জিনিসপত্রগুলি নামাইয়া লইল এবং আমাকে ইতস্তত; করিতে দেখিয়া বলিল, 
শিগগির নেমে আস্থন, এট! গাড়ী দাড়াবার জায়গা নয় । 

বলিলাম, আমার যাবার কি দরকার? 

সে বলিল, যারা এখানে আছে, তারা আভিজাত্যে কম নন আপনার চেয়ে, 
রাজেনবাবু। 

মার খাইয়া, গাড়ী ভাড়া দিয়! তাহার পিচ্ছনে পিছনে চলিলাম । অর্থাৎ 
ব্যাপারটা! এই দাড়াইল, চাবুকের শব্দ না করিলে আমাকে দিয়া কোনে। 
কাজ.পাওয়া যাইবে না। তাহার মহিত আপিয়া যেখানে দাড়াইলাম, তাছ। 
একটা ভৌতিক রাজ্য । গাড়ীর সেই সহিসটা আন্দীজে ঠাহর করিয়া মাথা 
হইতে জিনিসপত্র নামাইয়। রাখিয়। চলিয়। গেল। আমার মনে হইল-_ 
কলিকাত। শহর হইতে শত সহম্্র মাইল নির্বাসনে আপিঘা পড়িয়াছি ; কেহ 
বাহির করিয়। না দিলে, আর এই গোলকধ11 হইতে বাহির হইতে পারিবনা । 
মুন্ী আমাকে দাড় করাইয়। কোথায় যে মিশাইয়! গেল বুঝিতে পাৰিলাম 
না, মনে হইল গাড়ীখানা ছাড়িয়া দিয়া ভাল করি নাই। একবার উপর 
দিকে চাহিয়া একট্রখানি আকাশ দেখিতে পাইলাম । যাহ সন্গা। হইতে 
লক্ষ্য করি নাই, তাহাই এতক্ষণে চোখে পড়িল। দেখিলাম ফিক! একট্রখানি 
জ্যোত্সার আভাস কায়ক্লেশে এই খোলার চালের ভিতর দিয়। উঠানে আসিয়া 
পড়িয়াছে। পাশেই জলের ধারা বহিতেছিল, সেই জল প্রেতিনীর চক্ষুর 
হায় আমার দিকে মাঝে মাঝে কটাক্ষ হানিতেছিল। আমি নিরুপায় স্তব্ধ 
হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। 

অনেকক্ষণ পরে আলোর রেখা দেখা গেল। মৃন্ময়ী বাহির হইয়া আঙ্লি। 
কাছে আসিয়া চুপি চুপি কহিল, কারে! পায়ের শব্দ পাননি ত? 

বলিলাম, পায়ের শব! কার? 





৪6২. 


ঝড়ের সঙ্কেত 


কত লোক. আসে । দুষ্ট লোক বরং ভাল, কিন্তু ০০১ 
সন্দেহজনক । আমরা এখানে প্রাণ হাতে ক'রে থাকি । 

গা ছম-ছম করিয়া উঠিল। ঢোক গিলিয়া বলিলাম, পুলিশের কথা! 
বল্ছ ? 

মুন্ময়ী অদ্ভুত হাসি হাসিল । বলিল, বস্তির মেয়েমান্ষকে কেউ সন্দেহ 
করে না। আহ্বন।-ব্লিয়া আলোট। হাতে করিয়। সে অগ্রসর 
হইল । ৮ 

মানযষের সাড়াশব্দ কোথাও নাই, আমাকে লইয়। মুন্ম্ী কি উদ্দেশা সাধন 
করিবে তাহাও জানি না, কিন্ত মাটির দাওয়ার উপর গাঁ বীচাইয়া তাহাকে 
অন্থসরণ করিরা একটি কুঠবীতে আসিয়। ঢুকিলাম। চু নীচ মাটির উপর 
খবরের কাগজ ও দরমা পাতিয়। শষ্য প্রস্তত করা এবং সমস্ত ঘরে ছোট একটি 
ক্ুটকেস ছাঁড়। আর কোথা ৪ কোনে! আসবাব নাই । আমি এই প্রেতপুরীর 
ভিতরে ঢুকিয়া রুদ্ধনিশ্বাসে বলিলাম, এইটি বুঝি তোমার ঘর, মীন % 

হ্যা, ব্ন্ুন। এখানে আদরও নেই, অবহেলা ও নেই | 

দুই জনেই ব্সিলাম। 

বলিলাম, তুমি একা থাকো এখানে £ 

একা! মুন্মরী বলিল, আট ভাই বোন আছি পাশাপাশি ঘরে । ডাকবে 
তাদের ? এরা নিঃসাড়ে পড়ে আছে । আপনি যে নতুন মানুস। অপরিচিত 
কেউ এলে ওর গা ঢাকা দেয়। 

ওরা কি করে? 

কিছুই করে না, সুধু লুকিয়ে থাকে নাম ভাড়িরে। কিন্তু ছুর্ভাগ্যটা! কি 
জানেন। ভাইরা যখন থাকে ন।। অনেক মাতাল আপসে,_মনে করে 
এটা বেশ্যালয়। 
« আমি শিহরিয়া উঠিলাম। বলিলাম, সম্মান গেলে জীবনে আর থাকে কি, 
মৃন্মায়ী? 


৪৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মুন্ময়ী বলিল, সম্মান লোক কেড়ে নিতে পারে না, রাজেনবাবু, নিজের সম্মান 
থাকে নিজেরই মধ্যে । প্রবলের কাছে মহতের অপমান খুবই মহজ, কিন্তু তাই 
ব'লে মহ আপন মহিমা হারায় ন!। 

জীবনে যে-প্রশ্ন আমার ন্যায় অপঃপতিতদের মুখে কোনদিনই আসে নাই, 
আজ এই বাত্রির অন্ধকারে স্তিমিত প্রদীপ শিখার আলোয় বসিয়া মুন্য়ীর 
অপরিসীম যৌবনের দিকে চাহিয়৷ সেই প্রশ্নই আমীর মুখ দিয়। বাহির হইয়া 
গেল। বলিলাম, কিন্ত নারীধম রক্ষার একটা কথা াঁকে ত? অর্থাৎ ব্লপূর্বক 
যদি কেউ-_ 

মুন্সয়ী বলিল, আপনি যদ্রি অত্যাচার কল্রন আপনিই ছোট হবেন, আমার 
কোনো ক্ষতি হবে ন!। 

হঠাৎ হাঁপিয়া বলিলাম, হবে না? বলো কি? 

সহস! বেন বাধিনীর চোখ জলিয়৷ উঠিল, বলিল, নী, সেই ক্ষতি আমাকে 
স্প্শও করবে না। 

অনেকক্ষণ পরে বলিলাম, তবু, একট। কথা যাবার সমদ্র আমি ব'লে যাবো, 
আমাকে ক্ষমা ক'রো মীন । গায়ে পড়া কোনো উপদেশ তোমাকে দিয়ে যেতে 
আর আমার সাহস নেই, কারণ আমাদের কুচি আর আদর্শ সম্পূর্ণ আলাদ!। 
আমি বলছি আমাদের বাল্য পরিচয়ের অধিকার নিয়ে, আমরা সেই ছুটি উলঙ্গ 
বালক বালিকা গ্রামের পথে শিবের গাজন গেয়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতুম-_ 
আকাশ আর বাতাস আর সোনার ধানক্ষেত আমাদের কানে কানে কত কি কথা 
শোনাতো ; সেইদিনকার সেই বাল্যস্থৃতির অপ্রিকার নিয়ে জানতে চাইছি, এই 
, অভিশধ্চ, পলাতক, দরিদ্র আর হতমাঁন জীবন কি তোমার ভাল লাগে ? 

লাগে ।- মুন্ময়ী বলিল। 

কেন--কেন লাগে? বলবে আমাকে? 

অনুপ্রাণিত কণ্ে মুন্সী বলিতে লাগিল সেই সোনার ধানক্ষেত আমার 
দেখ নয়, রাছেনবাবু। এইখানে এ যন্ত্রণার মাঝখানে, এই দারিদ্র্য আর 


5৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


অপমান এই উত্পীড়ন আর পাশবিকতা__এর মাঝখানে খুঁজে বার করতে 
পারছি আমার সোনার দেশের হৃংপিগ্ড। উপবাসে আর যক্্ায় যাঁরা ধু কছে, 
আপন জীবনের ভিন্তিকে যারা ব্ধাক্ত করে তুলছে, যার! পাপ আর অন্যায় 
আর দুঙ্কৃতিকেই ধর্মবলে মেনেছে- সেই সব মুঢ পশু পর্গ আর বিকলাঙ্গদের 
নিয়ে আমি ঘর বেধেছি। আমিও সেই অভিশপ্ত দলের সঙ্গে এই গ্রকাণ্ড 
প্রশ্নের সমাধান করতে চাই, পৃথিবীতে একদল কেন ক্ষীত, আর একদল 
কেন কূশ! একদল কেন হবে অন্নদাত1, জার একদশ কেন বা অনহীন । 
পোনার ধানক্ষেত নয়, রাজেনবাবুঃ আমা ভাইবোনদের সর্প এই কাজেই 
আমি নেমেছি । আপনি আমাদের সাহায/ করবেন কি না বলুন। 

বলিলাম, আমি পুপিশকে অত্যন্ত ভয় করি, কারণ এদেশের পুলিন ভয়ঙ্কর । 
তোমাদের বে-আইশী সাহায্য করব কেন ? 

মুন্ময়ী বলিল, যদি বলি মনুষ্যত্বের আইনে ? 

তুমিই ত বলেছ__বড়লোৌকের মগয্যত্ব নেই ! 

তাহলে আপনার। যে আমাদের ঘর জাপিয়ে দিয়েছিলেন, তারই না হয় 
ক্ষতিপূরণ করুন? 

বলিলাম, পিতার অপরাধে পুত্রের প্রতি দণ্ড? 

মৃন্ময়ী সহস চুপ করিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল । পরে নিশ্বাস ফেলিরা 
কহিল, আপনি বোধ হয় জানেন না যে, আপনার বাধার কোঁনে। অপরাধ 
নেই। 

সাত্বন! দিয়ে না, মৃন্ময়ী । 

সত্যিই বলছি। 

উত্তেজিত হইয়! বলিলাম, ধিনি স্বহন্ডে তোমাদের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিলেন 
তাঁকে অপরাধী বলবে না? তোমর! মা-মেয়ে সংসারে কত ছলনাই জানতে । 

আমার আকম্মিক অসং্যত মন্তব্য শুনিয়! ব্থলিতবস্ত্রে মৃমময়ী সহসা উঠিয়া 
দাড়াইল, এবং সটান গিয়া ঘরের কোন হইতে ছোট সুটকেসটা আনিয়া 


8৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


খুলিল। ভিতরে ছোট একটা কাপড়ের মোড়ক ছিল মেটি খুপিয়া অতি 
'পুরাতন একখানি বাংলা ভাষায় লেখা পত্র ধীরে ধীরে খুলিয়া আমাকে 
দেখাইয়! বলিল, ভাল ক'রে দেখুন ত, হাতের লেখাটা কা'র চিনতে পারেন ? 
--এই বলিয়া সে আলোটা উজ্জল করিয়া দিল । 

অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া স্থলিত কম্পিত কণ্ঠে কহিলাম, আমার বাবার 
হাতের লেখা 

এবার সবটা পড়ুন, সুন্সয়ী দৃক আদেশ করিল । 

“সরোজিনী, তোমার ঘর পোঁড়ীইলাম, তাহার কারণ তোমার ও আমার 
ভিতরকার সম্পর্ক বত'মান সমাজ এবং আমার স্ত্রী স্বীকার করিল না । তোমার 
ইহজীবনের সমস্ত ভার আমি গোপনে বহন করিব। তোমার কন্যার বিবাহের 
জন্য তোমার নামে ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিলাম । 

ইতি-তোমার ত্রজেন্ত্র” 
স্ব বিমুঢ হইয়া মুন্মরীর মুখের দিকে চাহিলাম। মৃন্ময়ী চিঠি লইয়া 
হ্ুটকেসে বাখিয়া দোট পুনরায় তুলিয়া আগিল। তারপর ভাকিল, রাজেন্দ্রবানু ? 
সাড়া দিতে পারিলাম না। 

শুনছেন? চিঠি দেখানে! কি অন্যায় হল? 

মুখ তুলিলাম। মে কহিল, আবার আলছেন ত? 

ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলাম। তারপর বুকপকেট হইতে মণিব্যাগট। 
বাহির করিয়া তাহার দিকে ফেপিয়| দিলাম । সে একটু চিন্তিত হইয়া! আমার 
দিকে একবার চিল, তারপর মণিব্যাগট। তুলির কয়েকট। টাকা বাহির করিয়। 
লইয়! পুনরায় ব্যাগট! আমার বুকপকেটে রাখিয়া দিল । 

বোধ কি আগার উঠিবার শক্তি ছিল না, হাত প! সত্যই অব্শ হইয়। 
গিয়াছিল। মুন্সয়ী বুঝিতে পারিয়া আমাকে ধরিয়া! তুলিল, এবং হাত ধরিয়া! 
সন্তর্পণে বাহিরে আনিয়া গালির মুখে গিয়া বলিল, এরপর যেন বাবুকে আর 
খুঁজে আনতে না হয়। ও 


৪৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমি তাহার কথার উত্তর দিলাম না, কেবল আমার পিতামাতার হইয়া 
তাহার তথাকথিত কলঙ্কবতী মৃতা জননীর নিকট বারহ্বার ক্ষমা প্রার্থনা করিতে 
লাঁগিলাম। সমস্ত পথটা ধীরে ধীরে হাটিয়া চলিলাম। আকাশে ঘন মেঘ 
করিয়াছে; টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। 


চার 


সহসা আমাদের পারিবারিক জীবন ভয়ে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। গত 
তিনদিন হইতে বাবার অস্থখ যেন করত ক বিপদের সীমারেখার দিকে 
চলিয়াছে, আমাদের সমস্ত সংসারটা অস্বস্তিতে আলোড়িত হুইল । 

পিসিমা আপিলেন, বাবার এক অতি বৃদ্ধ কাকা আসিয়! উপস্থিত হইলেন, 
মামার! আসিলেন, মাসী "৫ তাহার তিন ছেলেমেয়ে আসিয়। জড়ে। হইলেন । 
ডাক্তার বাবু বলিয়াছেন, জরের লক্ষণ ভালো! নয়, সাবপান, বুকের ভিতরে 
জল ভর করিয়াছে । আমাদের বাড়ীতে রান্নাবান্না চড়ানে। দায় হইল । বাবার 
চারিদিকে সবাই আসিয়া ঘিবিল। 

আট টাকার ডাক্ত'র ব্দলাইয়া ঘোল টাক1 দামের ডাক্তার মানণিলাম। 
তাহার ওষধ যখন ধরিল ন| তখন বাবার প্রায় অচেতন অবস্থ।। আমি 
বত্রিশ টাকার ডাক্তারকে রোজ ছুইবার আনিতে লাগিলাম । 

চিকিৎসা শাস্ত্রে আমার জ্ঞান নাই, রোগের নাম ও উপসর্গের বিবরণ 
আমি মুখস্থ রাখিতে পারি না, কখন কি পথ্যের প্রয়োজন" তাহ। জানিয় 
রাখিতেও আমার বিগ্াবুদ্ধিতে কুলায় না । কেবল তাহাই নয়, রোগীর সেবা 
করিতেও আমি পারিয়া উঠি না। আমি ছুই চারিবার ছুটাছুটি করিতে পারি, 
গাড়ী করিয়া ডাক্তার আনিতেও অন্ুবিধা ঘটে না, আড়ালে থাকিয়া নিরাময় 
কামনা করাও আমার পক্ষে সম্ভব, কিন্তু অন্স্থের পাশে রাত জাগিয়া 


৪৭ 


বড়েরু সঙ্কেত 


চন 


বসিয়।-থাকা, সেব। কর।, 'ইষপ ও পথ্য খাও্য়ানে!, ওজন 'করিয় যত্র করা 
হে ঈগ্বর, আমাকে ছাড়িয়। দাও, আডালে গিয়া বরৎ ভাফ ফেলি! কাচি ! 

আত্মীয় স্বজনের ডিতনে আমি নরাপম বলিরা আখ্যাত ছিলাম, তাহারা 
আমাকে পঁচিশ বছনেন নাবালক বশিয়। তিরক্ষান্ন করিত। আজ তাহার? 
আসিয়া যখন বাবার রোগশযযাকে খিরিরা বনিল, আমি যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত 
নোধ করিলাছি। তাহাদের সহিত আমার সম্পর্ক কম, চিরকালই হিতাথি- 
গণকে এডাইয়। আসিয়াচি, ভতনাহ আজ ৭ তাহাতদর মারি ১ 
কনিবার কারণ দেখিলাম ন|। অবশ্য আাডালে আবডাছে থাকি! আমার 
প্রতি তাহাদের বিরক্তি-প্রর্ণান কানে ঘে আসিল নও তাহ। নহে । আমি 
পিতার একমাত্র সন্তান, সেভন্য মেন একট। পান্িবারিক ভঃগ আছে; আমি যে 
ভবিধাতে 'একট। বুহৎ সম্পত্তির উত্তরাঁপিকারী হইন, ইহ1ও ঘেন আমার একটা 
ভয়ানক অপরাধ । অনেকে আনেক সময়ে আমার উদ্দেশে কটাক্ষ করিয়া মানুক 
বলিতেন, ভাগ্যি তোমার ভাল নয় মা, একটি তরকারী তাও ভনে পোড়া ! 
আমাকে যত বারই তাহারা দেখিয়াছেন ততবারুই বলিরাছেন, বুঝলে বাবা, 
চরিত্রট বজায় রেখে চলো) বল! বাহুল্য, শাহাদের উপদেশ পাইয়া সেইদিনই 
প্রাণ ভবিমী চরিত্র নই করির! ঘরে ফিরিয়াছি। আমার জীবনে দেখিরাছি, 
সংযমশিক্ষা। দেওয়ার বক্তৃত। শুনিলে তখনই যেন মনের অসংযত প্রবুত্তিগুলি 
কিল্‌ কিল্‌ করিয়া বাহিরে আনিতে চায়। 

আমার বুকের ভিতরে কখনও জল ভর করিয়া জরে অচেতন হই নাই, 
স্থতরাঁং বাবার অন্থুখের গভীরতা! প্রথমটা আমার অগোষ্টর ছিল । কিন্তু মাঝের 
চক্ষু যখন জলে ভরিয়া উ্িতে লাগিল তখন তীহারই মুখে আসন্ন দুধোগের ছায়: 
দেখিতে পাইয়া শঙ্কিত হইয়া উঠিলাম। মায়ের মুখে চিরদিন তেজস্বিনীকে 
দেখিয়াছি, বাংসল্যের মধুর সঙ্কেত লক্ষ্য করিয়াছি: কিন্ত স্বামীর মৃত্যু আশঙ্কা 
করিয়া এমন একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা লক্ষ্য করি নাই। শুনিয়াছি নিতান্ত 
বালিকা-বয়সে মায়ের বিবাহ হইয়াছিল । ইহাও শুনিয়াছি, প্রৌঢত্বের শেষ 


৪৮ 


ঝাড়েবু সক্ষেত 


সীমায় আসিয়! দাড়াইবার পূর্বে একজন অপর জনকে ছাড়িয়৷ একটি দিনও 
যাপন করেন নাই,_আজ মায়ের মুখের চেহারায় যেন দেখিতে পাইলাম-_. 
সেই অচ্ছেগ্চ গ্রন্থির স্সাফুতস্ত্রে কেমন একট! বিচ্ছেদ সম্ভাবনার চিড় খাইয়াছে। 
ইহা কি বস্ত, তাহা আমি জানি না; ইহার ক নাম তাহাও আমার অজ্ঞাত? 
কিন্ত ইহার অন্তরে অন্তরে যে একটি মৃহৎ সংস্কৃতি ও শিক্ষা আছে, তাহাই 
যেন এই ছুর্যোগের আচ্ছন্ন সমস্ত পরিবেশের ভিতর হইতে আমি আহরণ 
কবিলাম। 

বাবার প্রদ্বীপটি ম্লান হইতে ম্লানতর হইয়া আসিল। আমার সকল চিন্তা 
স্তব্ধ হইয়া! একট] দ্রিকেই যেন ভীষণ হইয়া উঠিতে লাগিল । 

এই কথাটা? এতদিন কল্পনা করি নাই যে, মা-বাবার ছুইজনের একজন 
কখনও মরিতে পারেন; কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় যখন ডাক্তার আমার সহিত কথা 
না বলিয়৷ এবং ভিজিটের টাকা গ্রাহ্য না করিয়া সটান্‌ গিয়া মোটবে উঠিলেন 
ও ড্রাইভার গাড়ী চালাইয়া দিল, তখন আমি, পঁচিশ বছরের নাবালক 
ও নরাধম, আমার ভিতরট1 যেন ধক করিয়া উঠিল। ষে প্রাচীন বনম্পতির 
নিরাপদ ডালপালার ঠিতবে নিশ্চিন্তে বাস] বাধিয়! নানা জায়গায় খাবার ছে? 
মারিয়া খাইয়! এতকাল পরমানন্দে উড়িয়া বেড়াইতাম, মনে হইল, 
আজ বড় একট! কঠিন সমস্যার দ্রিকে ঠেলিয়! দিয়া সেই বনম্পতি শিকড় 
উপড়াইয়া হুমড়ি খাইয়া পড়িতেছে। আজ আমি চাহিয়া দেখিতে 
লাগিলাম, আমাদের এই বাড়ীর দেয়াল ও কড়িকাঠ, উঠান ও প্রাচীর, টেব্‌ল 
ও আল্মারি,_-সমন্তেরই চেহারা যেন এক আকম্মিক তুহিন-ঝটিকায় সম্পূণ 
বদ্লাইয়! গিয়াছে । আমি এইবার বাবার কাছে গিয়া বসিলাম। 

অচেতন অবস্থার ভিতরে তিনি কি যন্ত্রণা সহ করিলেন, মুখ বুজিয়৷ নীরবে 
কোন্‌ মন্ত্র জপ করিলেন, তাহা আমর! কেহই বুঝিতে পারিলাম না। মাত্র 
তেরোটি দিন রোগে ভূগিয়া তাহার অন্তিমকাল উপস্থিত হইল, তাহার চক্ষুর 
পলক আর পড়িতে চাহিল না। সকলে চেঁচাইল, কাদিল, গোলমাল করিল 


৪৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


এবং নেপথ্যে মহাকাল আসিয়া তাহার পাওনা আদায় করিবার জন্য হাত 
বাডাইলেন, ধীরে ধীরে বাবার মৃত্যু হইল । 

মৃত্যু আমি এমন করিয়া দেখি নাই । চিরদিন সম্তোগবাসনার দিকে মুখ 
ফিরাইয়! জীবন যাপন করিয়াছি, স্বভাব-্টটুলতার প্রশ্রয়ের ভিতরে বড় হইয়া 
উঠিয়াছি, বেদনা ও দুঃখ কি বস্ত্র, তাহ| আমার নিকটে অজ্ঞাত; দুর্ভাগ্যের 
কারুণ্য কাহাকে বলে তাহা আমি জানি না; কিন্তু আজ শ্রাবণ মাসের 
বর্ষণমুখর রাত্রে ষখন বাবার চিতা রচনা করিতে গিয়া ভিজা কাঠ জালাইতে 
না পাপিয়। ধোঁয়ায় চক্ষু অন্ধকার হইয়া আমিতে লাগিল, তখন আমি যেন 
সেই ছু' একট! আগুনের শিখায় নিজের চেহারাটাই একবার দেখিতে 
পাইলাম । মুন্ময়ীর মা যেদিন মবিগাছিলেন, মেদিনও শ্মশানে আনিয়া 
তাহাকে দাহ করিয়াছি; কিন্তু তাহার ভিতরে ছিল আমার মনের নিলিপ্ততা, 
পরোপকারের একটা চাপা গর্ব, প্রাণটা পড়িয়াছিল লোভের বস্কর দ্িকে। 
কিন্তু আজ যেন কেমন একটা নিদ্রা ভাডিয়া গেল, আমি সমস্ত সংসারের মূল্য 
নৃতন করিয়া! কবিতে লাগিলাম। আমার যেন দশ বছর বয়স বাড়িয়া 
গেল। 

ইহার পরে যাহা কৃত, তাহা একে একে শেষ হইল। অশোৌচ পার হইল, 
দান-সাগর শ্রাদ্ধ চঁকিল, নিয়ম-ভঙ্গ হইয়া গেল। আমি মুগ্ডিত-মন্তকের উপর 
একটি গান্ধী টুপি বসাইয়া পথে বাহির হইলাম । শোকের তীব্রতা কমিয়। 
গেল। কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের সহিত মা বিধবার বেশে পুনরায় সংসারের 
রাশ ধরিলেন। বলা বাহুল্য, তিনি আমার দিকে তাহার মুখ ফিরাইলেন। 

মাসথানেক পরে একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরিয়াছি, মা আমার ঘরে 
আসির়। দাড়াইলেন। বলিলেন, এ সব কি কাণ্ড রে? 

মুখ ফিরাইয়া বলিলাম, কি বল ত? 

তিনি বলিলেন, সরোজিনীর সেই মেয়েটা তোকে আবার খুঁজতে এসেছিল 
কেন? 


৫৪ 


ঝড়েরু সঙ্কেত 


এসেছিল নাকি ?--বলিয়া অনেকটা ওঁদাসীন্তের সহিত আমি জামাট। 
খুলিতে লাগিলাম। 

মা বলিলেন, কি দরকারে এসেছিল ? 

বলিলাম, তা ত” বলতে পারি নে। তবে বোধ হয় বাবা মারা গেছেন, 
তাই একটু সাত্বনা দ্রিতে-_ 

সাত্বনা দিতে এলো সে? দেশে আর লোক ছিল না? সে জানলে কেমন 
করে? 

এই কথাট। ভাবিয়া! দেখি নাই । আমি যে ইতিমধ্যে মুন্সয়ীর নিকট 
অনেকবার ধাতায়াত করিয়াছি, বাবার মৃত্যুর পরের দিনও তাহার নিকট 
একবেলা বপিয়া আলাপ-আলোচনা করিয়াছি, তাহাদের টাকা পয়সা দিয়াছি, 
বাবার আরও পুরাতন পত্র তাহার নিকট পাইয়! পড়িয়াছি, ইহা আমি চাপিয়াই 
ছিলাম। এ সম্বন্ধে আমার মনোবিকলন কাহারও নিকট 'প্রকাশ পাইতে 
দিই নাই | মায়ের প্রশ্নের উত্তরে কেবল বলিলাম, ত1”ত বলতে পারি নে। 

মা বলিলেন, আমি তাকে আগে চিনতে পারিনি । পরিচয় নিলুম, লে সব 
বললে। তোমাকে খুজতে এল কেন, তাই জানতে চাইলুম, বললে, এমনি । 
বলি, তোর ব্যাপার কি রে, বাজেন? 

হাসিয়া বলিলাম, কেন বলে! ত? 

মায়ের মুখ গম্ভীর, কঠিন। বলিলেন, তুই কি তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ 
করিস? 

বলিলাম, পাগল নাকি । 

তুমি জান রাজেন, এসব আমি ভালবামিনে ! 

আমি ধীরে ধীরে বলিলাম, তুমি অকারণে বড় বেশী কঠিন হচ্ছ, মা। 
সেকি তোমাদের কোনো ক্ষতি করেছে। 

মা বলিলেন, এ বাড়ীতে তার পা দেওয়াই ক্ষতিকর । তুমি যদি তার 
সঙ্গে ভাব আলাপ কর, সেই ক্ষতি আমার আরও বেশী । 


৫১ 


বড়ের সঙ্কেত 


আমি চুপ করিয়া রহিলাম। জবাব দিতে পারিতাম, কিন্তু তাহা অত্যন্ত 
রূঢ় হইত। মা জানেন না যে, আমি একটা বারুদের স্তপ হইয়া আছি। 
মা ইহাঁও হয়ত জানেন না যে, যাহারা দুর্বল, আমি তাহাদের হইয়া লড়াই 
করিবার একটা শক্তি সঞ্চয় করিয়াছি। আগে হইলে হয়ত মায়ের কথায় 
সতর্ক হইতে পারিতাম; কিন্ত পিতার চিতাগ্রির আভায় আমি যে নৃতন 
করিয়া সমস্ত সংসারটার ভালমন্দ পরীক্ষা করিয়া লইয়াছি, তাহাতে আর 
আমার কাহাকেও ভয় করিবার কারণ নাই । 

মুখে বলিলাম, আচ্ছা, ব্যস্ত হয়ো না, তুমি তোমার কাজে যাও। 

মা যাইলেন না। পুনরায় বলিলেন, তুই যার ছেলে তারই আদেশ যে, 
ওদের ছায়া কেউ কোনদিন মাড়াতে পাবে না । 

বলিপাম, বাবা এ আদেশ কবে দিয়েছেন, মা ? 

এ আদেশ তার চিরকালের । 

যদি সত্যি না হয়? 

মা বলিলেন, ঘি না জেনে থাক, তবে জেনে রাখো গুদের মতন অপামিক 
মানুষ ভূভারতে নেই । 

মুখে যাহা আপিয়াছিল তাহা বলিয়া ফেলিতে পারিতাম কিন্ত মায়ের দিকে 
পিছন কিবির়া একখান। চেয়র টানির। বসিয়। পড়িলাম। স্ত্রীলোক সম্বন্ধে 
আমার কিছু ক্ষিছু দুর্বলতার কথা ম। ষে একেবারেই জানিতেন না তাহা নহে, 
ইহার প্রতিকার করিবার চেষ্টা তিনি করেন নাই, কারণ তিনি মনে করিতেন 
আমার এ তুর্বলতা সাময়িক, যথাসময়ে এই নেশা কাটিয়া যাইবে । ইহা লইয়া 
তিনি এক আধবার সজাগ ও সতর্ক করিতেন, কিন্তু এমন করিয়া শালন 
করেন নাই । সরোজিনীর সম্বন্ধে মায়ের মনে যে গভীর ক্ষত আছে, আজ 
মুন্নয়ীর আনাগোনায় সেই ক্ষত হইতেই রক্তক্ষরণ হইতেছে । 

মা বলিলেন, চুপ কবে রইলি যে? 

বলিলাম, কি বলবো বল? 


৫২. 


ঝড়ের সঙ্ষেত 


ওকে একখানা পোষ্টকার্ড লিখে বারণ ক'রে দে, এ বাড়ীতে যেন না 
আসে। 

আচ্ছা দেবো ।-_বলিয়া আমি এক মুহূর্ত নীরব থাকিয়। পুনরায় বলিলাম, 
তাদের ওপর তোমার রাগের কারণটা জাশিনে অথচ আধামিক ব'লে আমি 
তাদের অপমান ক'রে তাড়াবো, এই কথাটাই ত আমি বুঝিনে। 

মা উষ্ণকে বলিলেন, ওর। একদিন আমাদের সর্বনাশ কর্বার চেষ্টায় 


বিশ্মিত হইয়া বলিলাম, ওই মা আর মেয়ে? 

হ্যা। 

ওদের চাল চুলো নেই, শক্তিসামথ্য নেই, মাথার ওপর কোনে! সহায় নেই, 
ওরা করবে আমাদের সর্বনাশ ?--এই বলিয়! হাসিলাম | পুনরায় বলিলাম, 
এ যেন অনেকট? ভূতের ভয়, মা। 

মা কাছে আসিলেন। কিন্ধু উপলব্ধি করিলাম, আমার মাথায় হাত 
বাখিয়াই তিনি কাদিয়। ফেলিলেন। বলিলেন, গর! সব পারে । ওই মেয়েকে 
কখনও বিশ্বাস করিস্নে, ওর রক্তের মধ্যে আছে শয়তানী বুদ্ধি। 

বলিলাম, কিন্তু তোথার মতন মনৌভাব হয়ত বাবার ছিল না। যাক্‌গে 
ওদের আলোচনা । আচ্ছা, আমি বলে রাখলুম আর কোনদিন মে এ 
বাড়ীতে প1 দেবে না। 

তুইও যাবনি বল? 

আচ্ছা । 

মা চোখ মুছিয়া চলিয়া যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, যদি মায়ের মান 
বজায় বাখতে চাঁদ, তবে আর কোনদিন ওদের ছায়া মাড়াবিনে । 

এমন একটা বেকাঁর-বিকৃত জীবনকে লইয়! আমি কি করিব তাহাই 
ভাবিতে লাগিলাম। আমি যে কাছের মানুষ নহি, ইহা! আমি যেমন বুঝিয়াছি, 
অপরেও তেমনি বুঝিতে পারিয়াছে। কিন্তু তবু জীবনটাকে লইয়া! আপাতত 


৫৩ 


বাড়ের সঙ্কেত 


কি করা যাইতে পারে, তাহাই চিন্তা করিতে করিতে একদিন পথে বাহির 
হইয়! পড়িলাম। 

বাবার উইলের প্রবেট পাইতে আমার বিলম্ব হইবে না। কলিকাতায় 
যে পাচখান। বাড়ী আছে, তাহার চারখান| আমার, একখানা মায়ের নামে । 
কোম্পানীর কিছু কাগজ মায়ের, বাদ-বাকী সমস্তই আমার। চটকল ও 
সিমেন্ট কোম্পানীর সমস্ত শেয়ারগুলিই আমার। ব্যাষ্কের টাকা হইতে ম। 
মাত্র দশ হাজার পাইবেন, বাকি সবই আমার । খুচরা পাচ দশ হাজারের কথ 
আমি চিন্তা করি না; কারণ তাঁহ। জগ্তালের ন্যায় আমার পায়ের কাছে 
আসিয়া পৌছিবে জানি । 

মনে করিলাম, কিছুকাল জুয়া খেলিয়া আনন্দলাভ করিব । কিন্তু ভাগ্য 
অপেক্ষা কৌশলের প্রশ্ন যে খেলায় বড় বলিয়া আমি সন্দেহ করি, সেখানে 
আমি পারিয়া৷ উঠিব না। আমি দুষ্ট ও ছুরন্ত, কিন্ত তাহা চাতুরী অপেক্ষা 
নিরুদ্ধিতার পথ ধরিয়৷ চলে,__ন্থতরাং জুঙগাখেলায় হারিতেই হইবে, জিতিতে 
পারিব না। আমার অভিন্নহৃদয় দুই চারি জন বন্ধু পরামর্শ দিলেন, একটা 
সিনেমা কোম্পানী খুলিয়া! ছবি তুলিলে সব দিকেই লাভবান হইব। স্ুম্বরী 
অভিনেত্রী সংগ্রহ কর। কষ্টকর হইবে নী এবং তাহাদের অনেক সময়ে ভদ্র ও 
সন্ত্রান্ত পরিবার হইতে সংগ্রহ করা যাইতে পারে। প্রাণের ভিতরট1 পুনরাঁয় 
খুশি হইয়। উঠিল। এই দ্রিক্টার সহিত আগে হইতেই আমার কিছু কিছু 
পরিচয় আছে; আর কিছু নাই হোক, অভিনেত্রী সংগ্রহ করিয়! বেড়াইতে 
পারিলে আমার ইহকাল ও পরকাল ছুই রক্ষা হইবে। বন্ধুরা সতর্ক করিয়। 
দিলেন, খবরদার, বিবাহ করিতে পারিবে না কিন্তু, করিলে সব মাটি হইবে। 

বলিলাম, তথাত্ । 

ঝুপ করিয়া একদিন কাজে ন।মিয়া পড়িলাম। কিন্তু কাজে নামিবার সঙ্গে 
সঙ্গে একদল ভদ্রলোক একদিন দেখ। করিতে আপিয়! বলিলেন, তাহার] আমার 
সাহায্যে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিতে চান। 


৫8 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পুলকিত হইয়া বলিলাম, খুব ভাল কথা, এ ত" দেশের কাজ । ইস্কুলট। 
কেমন হবে? 

তাহারা বলিলেন, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই পড়াশুনা করবে । সহশিক্ষার 
প্রসার । 

বলিলাম, খুবই উপকার হবে, কারণ এতে বিবাহের যৌতুক প্রথাট। উঠে 
বাবে। স্বাধীন প্রণয়ট। চালু হয়ে গেলে ছেলের বাপরা আর টাকা চাইতে 
ভরসা করবে না। সহশিক্ষা পরিণত ফল পণ-প্রথা-নিবারণ । 

ত:হারা লজ্জিত হইয়। বলিলেন, আজ্ঞে, এদিক থেকে কথাটা আমন? ভেবে 
দেখিনি, আমর শিক্ষাপ্রদারের দিক থেকেই ভাবছিলুন। 

বলিলাম, এটা হ'লে ওট। হবে। ধরুন, ঘটকাপির টাকা লাগবে না, 
অলঙ্কারপত্র ইচ্ছামত, বিবাহের সামালিক খরচ ক'মে গেল, ছেলেমেয়ের পছন্দ 
ভবে নিরিপ্র প্রণয়ের ব্যাপারে মেয়ের বাপ হবে লাভবান । বেশ, আপনারা 
ভাই করুন, আমি বাজি । 

কিন্ত শিক্ষার দিক থেকে--তীভার] বলিলেন । 

হবে বৈ কি, ওটাও হবে। ধরুন, একট] উতংকুষ্ট প্রজাপতি-সমিতি গণড়ে 
০োলাও ত” দেশের একট। মন্ত বড় কাজ। 

তাহার কি যেন সন্দেহ করিয়| “আবার একদিন আসবো" বলিছা দেদিনকার 
মতো বিদায় লইলেন। কিছুদূর গিয়। সহদা একজন পিছন ফিরিয়া লক্ষ্য 
করিলেন, আমি তখনও তাহাদের দিকে চাহিয় হামিতেছি । বল! বাহুলা, 
আর তাহারা আসেন নাই । 

যে পরিমাণ টাকা আমার আছে, তাহাতে আমাদের জীবন নিশ্চিন্তে 
চলিয়া যাইবে । সেই টাকাকে ব্যবসায়ে খাটাইদ্া! বাড়াইবার প্রয়োজন আমার 
নাই; বরং তাহা হইতে যদি বাকিছু নষ্ট নগ, তাহাও স্বীকার করিয়া লইতে 
পারিব। আর নষ্টই বা বলিব কাহাকে? মুন্ময়ীকে যেট্রকু সাহাধষ্য করিতে 
পারিয়াছি তাহা মায়ের বিচারে নষ্ট, কিন্ক আমার বিচারে হয়ত সার্থক । 


৫৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


হ্তরাৎ এই কথাটাই সর্বাগ্রে জানাইল, নষ্ট হওয়া বলিয়া কোন পদার্থ জগতে 
নাই, কিছুই নষ্ট হয় না, সমস্ত বস্তুরই একট: চরম লক্ষ্য আছে। 

এই ষে আমি সেদিন একটি পাঠাগার-প্রতিষ্টার জন্ত কিছু টাক1 ও বই খয়রাৎ 
করিলাম, এই যে সিনেমা কোম্পানী খুলিবা জন্ত এই প্রতিযোগিতার বাজারে 
ছুঃসাহমিকের ন্যায় অবতীর্ণ হঈতেছি, ইহার উদ্দেশ্য কি কেবল লাঁভবান্‌ হওয় ? 

কিন্তু আমার ভাগ্যবিখাতা যে আমার পাশে থাকিয়াই নিরন্তর হাসিতে- 
ছিলেন, আমার সেদিকে লক্ষ্য ছিল না। 

সিনেমা কোম্পানীর অফিস খুলিবাঁর জন্ত কলিকাতার জৎপিগ্ডে একটি বাড়ী 
ভাঁড়া করিলাম । বালিগঞ্জে অন্তের একটি ই্টডিও প্রয়োজন মত ভাড়া 
লইব, এবং এই বাড়ীটা হইবে আমাদের স্থানীয় কমকেন্দ্র। অতএব 
অভিনেতা ও অভিনেত্রী চাহিয়া আমি নিজের নামে দৈনিক সংবাদপত্রে 
বিজ্ঞাপন দিলাম । বল। বাহুল্য, যে সকল গুণপণা দাবী করিয়া বিজ্ঞাপন 
প্রকাশ করিলাম, তাহাতে পতিতাগণের পক্ষে আবেদন করা সম্ভব নয়। 
আমার উদ্দেশ্য ছিল বহস্যময় | 

এমন একট! প্রতিষ্ঠানের আমিই চালক হইব, ভাবিতেই আমার রোমাঞ্চ 
পুলক লাগিতেছিল । সন্ধ্যার সময়টাই প্রশস্ত, দেখা-সাক্ষাৎ করিবার জন্য 
এই সময়টাই দিয়াছিলাম। দুই তিন দিন কেহই আমনিল না, চার দিনের দিন 
খবর পাইলাম, একজন মহিলা আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন । 
তাহাকে বাহিরে বসানো হইয়াছে। 

অভিনয়-জগতের মেয়েদের পক্ষে সর্বপ্রধান প্রশ্র_-রপ। বূপশ্রী, স্বাস্থ্য, 
শরীরের ছন্দময় গঠন, কঠম্বর-_এগুলি হইতে শিক্ষা ও কৃতিত্বের অভাব পূর্ণ 
করিয়া লওয়া যায়। বূপহীনা মেয়ে আমি আমার কোম্প'নীতে নিয়োগ 
করিতে পারিব না, এই আমার সঙ্কল্প ছিল। সেই জন্ত আমি আমার নব- 
নিধুক্ত কেরাণীকে ভাকিয়া বলিলাম, আগে তুমি বাইরে গিয়ে দেখে এসো 
ত মেয়েটি দেখতে কেমন ? সেই বুঝে তার সঙ্গে আলাপ করবো । 


৫৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


কেরাণী ছোকরা বাহির হইবা গেল এবং মিনিট দুই পরে আসিয়া 
আমার সম্মুখে ঢোক গিলিয়! দাড়াইল । বলিলাম, কেমন দেখলে ? 

সে কহিল, এমন কখনও দেখিনি । 

এতই কুংপিৎ !--মাপনিও এমন কখনও দেখেন নি আঘি বাজী রেখে 
বলতে পারি। 

দেখতে স্থন্দর কি না, তাই আগে বলো। 

সে কহিল, অতি আশ্চধ্য রূপ, একেবারে দেবীস্বরূপ। আপনার প্রত্যেক 
বইয়ের প্রধান নায়িকা হবার যোগ্য। 

আচ্ছা, ডেকে আন। 

কেরাণীটি বাহির হইয়া যাইতেই আঘি আমার মাথার চুলটা ঠিক করিয়া 
লইলাম; ভবা হইয়। বপিয়। মুখের উপর একটি মিষ্ট হাদি টানিয়া আনিলাম 
এবং এমন করিয়াই দরকারী কাগজ-পর্রের মপ্যে নিজেকে ডুবাইয়। দিলাম 
যে, বেশীক্ষণ কথাবাতি1 বলিয়া কিছুতেই সময় নষ্ট করিতে পাবিব ন]। 

বাহিরে হিল্-তোল। জুতার শ্দ পাইলাম, আনন্দে শরীর রোমাঞ্চ হইয। 
উঠিল। কিন্ধ পর মুহতেই পদ? তুপিয়া ঘাহাকে প্রবেশ করিতে দেখিলাম, 
তাহার পর আমার মুখে আর কথা সবিল না। 

মুন্ময়ী নিজেই একখান! চেয়ার টানিয়া বগিল, এবং আমার কেরাণীকে 
কহিল, আপনি দয়া ক'রে এবার বাইরে যান। 

ছোকরা আমাদের ছুইজনের মুখের দিকে চাহিদা সহদা মুখ ফিরাইয়। 
বাহির হইয়া গেল । 

মৃন্ময়ী হানি মুখে বলিল, কত মাইনে বলুন ? 

আমি 9 এবার হাসিলাম, বলিলাম, যোগ্যত1 বিচার ক'রে তবে ত মাইনে । 

ওঃ, আমি খুব ভাল অভিনয় করতে পারি, তা বুঝি জানেন ন1? 

বলিলাম, জানি, দেখতেই ত" পাচ্ছি। সাজসজ্জার এত ঘটা, রুজ- 
পাউডারের এত চাকচিক্য,_আমার ওই কেরাণীটির একেবারে মাথা ঘুরে গেছে । 


৫৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


সুন্ময়ী বলিল, কি করব বলুন, এ নাহলে ত' আপনার এখানে চাকরী 
হবে না। 

বলিলাম, মুন্ময়ী, তুমি নাচতে গাইতে জান? 

খুব জানি। 

কত মাইনে চাও? 

সে হাপিয়া কহিল, আপনার মতন স্বত্বাধিকারীর কাছে বিন মাইনেয় 
চাকরী করব। 

আমি হাপিয়! ফেলিলাম, তোমার উদ্দেশ দেখছি অতি মহৎ। শিল্পকলা- 
প্রমারের দন্ স্বার্থত্যাগ 1 

মে এইবার গল] নামাইয়া বলিল, মায়ের ওপর রাগ ক'রে এসব কি কাণ্ড 
করছেন বলুন ত? 

কেন, এ ব্যবসা কি মন্দ? 

আপনি কিচ্ছু জানেন না এই ব্যবসার । মাঝখান থেকে কতকগুলো 
নোতর! ঘাটাঘাটি করবেন, আমি বুঝতে পাচ্ছি । একাজ আপনাকে ত্যাগ 
করতে হবে। 

সভয়ে বলিলাম, কি বলছ মৃন্ময়ী, কতদূর আমি এগিয়েছি জান? 

জানি। দুচারজন লোককে কাজে নিযুক্ত করেছেন, যন্ত্রপাতির দরদস্তর 
করছেন, বাড়ীট। ভাড়া নিয়েছেন আর কাদ পেতে আছেন ভদ্রঘরের ছেলে- 
মেয়েদের অপত্পথে নিয়ে যাবার জন্য ।_-এই বলিয়া মৃন্য়ী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে এদিক 
ওদিক তাকাঁইতে লাগিল । 

বলিলাম, তুমি জান যে, ইতিমধ্যে এর জন্যে আমি অনেক টাঁক। খরচ 
করেছি? 

কত টাকা? 

প্রায় দেড় হাজার । 

আমি দিয়ে দেবো, এ কাজ আপনি বদ্ধ করুন । 


৫৮ 


ঝড়ের সহ্কেত 


তুমি দেবে ? "বলিয়া হো-হে করিয়া! হাসিয়া উঠিলাম। 

ঠ্যা, আমি দেবে! এই বলিয়! সে তাহার হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটি আমার 
টেবলের উপর ছু'ড়িয়া দ্িল। 

অবাক্‌ হইয়া বলিলাম» কি আছে এর মণ্যে? 

সে বলিল, যা আছে আপনি রেখে দিন্, আমার চালচুলে। নেই, আমি ও 
সব রাখবো কোথায়? 

তাহার বাগ খুলিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম । বলিলাম, এ কি, এত 
টাকা তুমি পেলে কোথায়? 

সে কভিল, দেশবাসীর টাকা । 

মানে? 

মানে, আমার ভাইরা ছিনিয়ে এনেছে ব্যাঞ্চ থেকে | 

কি ভাবে? 

এমন কিছু নয়, প্রাণভয় দেখিয়ে । 

ভয়ে সর্বশরীরে কাট] দিল । টেক গিলিঘ্া শুধ্ষকগে বলিলাম, এ টাকা 
আমি রাখবো দ্বীপান্তরে যাবার জন্যে ? 

মৃন্ময়ী বপিল, না । আপনি কেবল এই নোংরী কাজ ত্যাগ করুন, ঠনলে 
আমিই আপনাকে দ্বীপান্তরে পাঠাবো । 

বলিলাম, তৃমি আমার চিঠি পেয়েছিলে? তোমাকে জানিয়েছিলুম আর 
কোনদিন আমাদের দেখা হবে না। 

হাসিমুখে মৃন্মী বলিল, চিঠিতে মায়ের প্রতি অভিমান ফুটেছিল, আর যা 
অস্পষ্টভাবে ছিল সেটা আপনার ছেলেমানুষী । 

তার মানে? 

মুন্য়ী নতমস্তকে বলিল, সে সব অতি বাজে কথা । 

ঠিক মনে নেই, কি বল ত। 

সে আবার হাসিল। বলিল, উচ্ছ্বাস আর স্তাবকতী। 


৫৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মিছে কথা । আন সে চিঠি । 

সে কহিল, মিছে কথা হলেই খুশি হবো । সে চিঠি আমি আগুনে পুড়িয়ে 
ফেলেছি । নিন, উঠন, আর দেরী করবেন না, অনেক কাজ । 

বলিলাম, আমি উঠবে! কোথায়, এখানে আমার অনেক কাজ বাকী । 

মুন্সয়ী বলিল, আমি রাঁগলে কিন্তু আপনার রক্ষে নেই। এখানকার সব 
কাজ আপনাকে বঞ্ধ করতে হবে। যার যা পাওনা আছে, চুকিয়ে দিন,_ 
আমার সমর বড় কম।-_-এই বলিয়া সে পাশের ঘরে উঠিয়া গেল এবং এক 
মিনিটের মধ্যেই আমার কেরাণীকে ভাকিয়। আনিল। 

বলিলাম, বিনয়, আমি একটু কাজে যাচ্ছি । মেয়েরা যদ আর কেউ আসে 
কাল আসতে বলে দিও । 

মুম্ময়ী বলিল, বিনয়বাবু, ও'র কোন কথার ঠিক নেই, আমি সা বলছি 
তাই শুষ্গন। সিনেমা কোম্পানী উনি করবেন না, যদি কেউ আসে ফিরিয়ে 
দেবেন-_ 

বাধা দিয়া বলিলাম, আরে, কি বলছ তুমি ? 

মৃন্মঘ়ী আমার কথা শুানিল না। বলিতে লাগিল, আপনাদেরও কাল থেকে 
আসবার দরকার নেই । তিন মাসের মাইনে প্রত্যেকে আপনার! পাবেন। 
কাল সকালে গর বাড়ীতে গিয়ে সেই টাকা আনবেন। 

বিনয় ফ্যাল-ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল। পরে বলিল, তবে কি কিছুই 
হবে না? 

না। 

আমি আবার বাধা দিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্ত মুন্ময়ী বলিল, বুঝলেন 
বিনয়বাবু, মার ওপর রাগ ক'রে উনি টাকা নষ্ট করিতে বেরিয়েছেন, কিন্তু নষ্ট 
করব বললেই বা করতে দেওয়া হবে কেন? আচ্ছা, এবার আপনি যাঁন্‌। 
কাল এসে টেবল চেয়ার আলমারি আর আসবাবপত্রগুলি ফেরৎ দিয়ে 
আমবেন। 


৬০ 


ঝড়ে সন্কেত 


বিনয় মাথা হেট করিয়া চলিয়া গেল। 

বলিলাম, করলে কি, মুনুর়ী ? 

মুন্ময়ী বলিল, অসৎ পথ থেকে আপনাকে সরিয়ে আনা হল। 

রাগ করিয়া বলিলাম, ভাকাতি ক'রে টাকা ছিনিয়ে আনা আর ধমের 
ষাড়গুলোকে বসিয়ে খাওয়ানো বুঝি সৎপথ ? 

হাসিয়া সম্েহে মৃন্ময়ী বলিল, খুব বক্তৃতা হয়েছে, এখন চলুন । 

কোথা যাবে? 

চলুন বেড়িয়ে আসা যাক্‌ একটু । 

তুমি এই লাজনজ্জা ক'রে যানে আমার সঙ্গে, লোকে বলবে কি? 

সে আমি বুঝবো, আস্থন। 

মুন্সীর উপর রাগ করিলাম কিন্ত তাহার আদেশ অগান্ত করিতে পারিলাম 
ন1। রেশমী শাড়িথান। এমন অপরূপ কৌখলে সে তাহার দেহলতায় 
ত্াটাত্াটি করিয়া! জঢাইয়াছে, চুলেন্ ঝুণি শামাইঘ। হন্দর মুখখানিতে এমন 
করিয়া প্রসাধন আকিয্লাছে, এমন করিধাই তাহার বাজহংসীর চলন ঢলঢল 
করিতেছে যে» তাহার অবাধ্য হইবার সাধ্য আমার রহিল না। পিতার মৃত্যুর 
পর এই প্রতিজ্ঞা করিয়াছি বে, মেরেদের সহিত মিশিব কিন্তু দেহাসক্তির 
উত্তেজন। তাঙাদের শিকট আর প্রকাশ করিব না। ভাবিলাম মুনুয়ীর এই 
আদেশ কেন মানিয়া লইতেছি? এখন৪ আমি তাহান্ন €প্রমে ডুবি নাই, 
এখনও আমি তাহাকে নষ্ট করি নাই যাহার জন্ত চক্ষুলজ্জ| মানিব, এখনও 
তাহাকে তাহার এই টাকাকড়ি কাড়িঘ়া লইয়। বিদায় করিন| দিতে পারি, 
কিন্ত নিজের মনের চেহ।র1 আমি অনুভব করিতে পার্িলাম। আম একজন 
ওপন্তাসিক হইলে এখানে রূস ফলাইযা সত্য ও সততাকে চাপ! দিতে 
পারিতাম, কবি হইলে রং বুলাইয়৷ এখানকার ইতর আত্মপ্রতারণাকে ঢাকিতে 
পারিতাম কিন্ত তাহ! হইবার নয় ॥। মুখে প্রতিজ্ঞ করিয়াছি, সাধুতার ছদ্মবেশ 
চড়াইয়াছি কিন্ত মনে মনে প্রাণের তটে ভাঙন লাগিরা আছে। আমার 


৬৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


রক্তগত যৌন-শৈথিলা ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে বন্তজন্তর হ্যায়. ভিতরে ভিতরে 
মৃগ্ময়ীকে লেহন করিতেছে, এই সত্য চাপিব কাহার ভয়ে? হয়ত মৃণ্য়ীও 
'আমার এই লাংস্কারিক প্ররুতির সন্ধান ভ্রমশ পাইয়াছে, সেই জন্য আমাকে 
বাগ মানাইতে ভ্ইলেই মে একটা অদ্ভুত বিলাসিনী রমণীর বেশ ধরিয়া আসিত। 
সে থেন বারে বারে এই কথাটাই প্রকাশ করিয়াছে, আমি যদি আমার স্বভাবে 
দৈবভাব আনিতে চাই তবে তাহাকে কেন্দ্র করিয়াই আনিতে হইবে, আর 
যদি বীভৎস প্রবৃত্তি তাড়নায় অতল তলে তলাইতে চাই, তবে তাঁহারই 
হাত ধরিয়। নামিম্। যাইতে পারিব, কিছু অস্বিধ। হইবে না । 

স্ীলোকের পরিপুষ্ট দেহ পাইলেই আমি খুশি থাকিতাম, তাহাদের মনের 
দ্রিকে চাঠিখার ইচ্ছা ও অবসর আমার হয় নাই, ও-বস্ত তাহাদের মধ্য আছে 
এই সংবাদ শুনিলেই আমি হাপিয়া ফেলিতাম । উহারা জীবন্ত মাংস-পিণ্ডের 
নায় চলিয়া কিরিয়া বেড়ায়, ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে পৃথিবার জল-বাতাসে 
উহ্বারা স্থপুষ্ঠ হয় এবং আমাদের ক্ষুপ্ণা পাইলেই উহাদের ধরিগা কচি ও নর্ধুর 
মাংসের আন্বাদ করি-__ ইহাই বিশ্বের নারীজাতির আবহমান কালের ইতিহাস। 
হষ্টির বিবর্তনে মানুষের এতিহ-কাহিনী, পুরুষের ববরতা ও সাধুতা, পুরুষের 
ভোগ ও ত্যাগ, পুরুষের হষ্টি ও ধ্বংস--ইহাদেরই কেন্দ্র করিয়! রচিত হইয়াছে, 
সেখানে নারীর ব্বাতক্ত্র্যের কোথায় প্রমাণ পাইলাম ? শক্তির আঁধার বলিয়া 
নারীকে ধাহার1 হলািনীর উত্স বলির স্ততিবার করে তাহারা কি জানে 
না ষে পদ্মের ভিতরে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা স্র্যদেবতারই অন্রগ্রহে? জানে না কি 
পুরুষের পত্রাস্থি হইতেই তাহাদের শক্তির উদ্ভব? কবি বলো, দার্শনিক 
বলো, যোগী বলো»-_নারীর স্তৃতিবাদের মুলে তাহাদের দেই একই স্থঙ্জন- 
কামনা, একই যৌন শৈথিলে)র লক্ষণ,--অন্ততঃ ইহাই আমি বিশ্বাস করিতাম। 

কিন্ত আমার জীবনে যে-পথবাসিনীকে পথের উপর হইতেই কুড়াইয়া 
পাইলাম, আজ এই সন্ধ্যায় তাহাকে সহসা অপরূপ বলিয়া মনে হইল। উচু 
আসনে তাহাকে বসাইয়া নারী-লোলুপ বাক্যবাগীশের ন্যায় পুজা দিবার 


৬২ 


ঝড়ের সন্কেত 


দুপ্পরবৃত্তি আমার নাই, তাহাকে লইয়া প্রাণের মধ্যে গীতিকাব্য রচনা করিবার 
অবসরও আমি খুঁজিয়া পাইলাম না, কিন্তু অন্ধকার পথে নামিয়া মৃন্ময়ীর 
হাতখান1 ধরিতে গিয়া সহ] নিজেকে সম্বরণ করিলাম। আমার দছুরস্ত 
রথচক্রের গতির পথে যে-মেয়ে অলজ্ঘা বাঁধা বিস্তার করিল, আজ তাহার মুখ- 
খানি আর একবার ভালো করিয়া দেখিলাম । বিলাসিনীর লোভনীয় সাজসঙ্জায় 
ইহা রমণীর মুখ সন্দেহ নাই, আমার নারকীয় কামনার সহচারিণী হইবার 
আপনত্তিও সে-মুখে দেখিলাম না, আমার সহিত পাভালপথে যাইতেও সে প্রস্থত, 
কিন্তু তবু যেন আমার কেমন সন্দে5 হইল । সেদিন বাত্রে এই রমণীই কল্যাণী 
প্রতিমার মৃতিতে আমার সম্মুখে বসিয়। আমারই জগ্ত কাদিয়া ফেলিয়াছিল, 
মামীর ভিতর হইতে দেবত্বকে উদ্ধার করিরা আমার জীবনকে উব্বণয়িত করিয়া 
তুলিবার একটি পরম ব্যাকুলত। এই মুখের উপরেই অগ্ষিত দেখিয়াছিলাম। 
ভালাবাসা পাইতে চাহে না,আমাকে ভালোবাপির! আমার জীন্নকে অস্থবিদার 
মধ্যে লইতেও তাহার অভিরুচি নাই, তাহার জীবনের কোন স্বার্থকে আমার 
সহিত জুড়িয়া দিয়া কাজ হাদিল করিবার কন্দীও তাহার দেখিলাম না,_ সেই 
রাত্রে আমার ভয় হইয়াছিল পাছে ইহার প্রভাগ্বে পড়িঘ। আমি রাতারাতি 
সচ্চরিত্র হই! উঠি । সেদিন আমি পলাইয়া আম্মবক্ষা করিয়াঞ্ছিলাম। আজ 
আবার ইহার সাজসচ্জার নৃতন খেল দেখিয়া আমি ভয়ে আডষ্ট হইয়া উঠিলাম। 

আমার হাতে তাহার টাকার ব্যাগটা ছিল, পথে নামিয়া বলিলাম, 
এইভাবে ভোমরা টাকা আনো, বিপদের ভয় করে| না? 

সুন্ময়ী বলিল, বিপদ ত মান্ধষের পদে পদে, তাই বলে কি বসে খাকবে।? 
আপনিও ত” একট। মৃতিঘান বিপদ । এই বলিয়া সে হামিল। 

ইহার অকপট সাহম দেখিয়া অনেকদিনই আমি শিহরিয়া উঠিয়াছি, মনে 
মনে ইহার নিকট নিজেকে ভীরু বলির অন্ভভব করিয়াছি, কিন্তু তাহার শেষ 
কথাটায় আমিও হাসিয়! ফেলিলাম। বলিলাম, তবে এমন বিপদ মাথায় 
নিয়ে রাস্তাঘাটে চলাফেরা কেন? 


৬৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


সে বলিল, বিপদকে নিয়ে খেলা করায় কম শাঁনন্দ ? 

বটে, আমি তোমার খেলার সামগ্রী ? 

আপনাকে নিয়ে খেলা করব কেন, করি নিতে এই প্রাণ নিয়ে. 

প্রাণের মায়া নেই তোমার? 

খুব আছে 1-_মুন্ময়ী বলিল, আমার কেউ নই বলেই আমি নি? 
কেউ থাকলে তারই কাছে আশ্রয় নিতুম, রাজেনবাবু। 

তাহার কথায় কারুণ্য ফুটিল। বলিলাম, স্বাহীন মেয়ে আমিও পদ্ম 
করি, কিন্তু তার জীবনের ভিত্তিট! খুব শক্ত হওয়া দরকার । নইলে স্লোতে 
আগাছ। হওয়ার নাম ব্বাধীনতা। নয়। 

মুন্ময়ী মুখ তুলিয়া স্বচ্ছকে কহিল, আগাছা! কেন হবো? মা মারা ধাবা' 
সঙ্গে সঙ্গেই ত আমি আপনার দেখা পেলুম। 

মানে? 

চলিতে চলিতে হাঁলিমুখে সে কহিল, ভয় নেই, বিপদ আমিই মাঁথা পেত 
নেবো, আপনাকে বিপদে ফেলবো না। লোকের কাছে কি আর বলবে। 
আপনি আমাৰ আশ্রয়দাতা ? 

বলিলাম, মনে মনেই বা কেন বলবে? আমি ত তোমাকে আশ্রয় দিইনি? 

সে পুনরায় মুখ তুপিয়া বলিল, মেয়েমানগষ কি ভাবে আশ্রয় পায় একি 
আপনি জানেন ? 

বলিলাম, আমার ছুর্বলতা কোথায় তা তোমাকে জানিয়েছি । আমাকে 
এতটা] বিশ্বাস ক'রো না মুন্সী । 

এ ত' বিশ্বাসের কথা নয়, নির্ভরের কথা। 

আমার বুকের ভিতরট! কেমন যেন কাপিয়া উঠিল । পথ চলিতে চলিতে 
বলিলাম, আমার ওপর কোনে মেয়ে নির্ভর করেছে, একথা শুনলে আমি 
শ্রদ্ধা কখনো! করিনি, তাদের কল্যাণ-চিন্তা মনে কোনোদিন আনিনি। একি, 
কোথায় চলেছি বলো ত? 


৬৪ 


ঝছেনু স 


হে 


ককের সন রর 
রি ক নি 


হ'জনেরই যেন নক ভাঙিল। চলিতে টলিতে অনেক দূর আসিয়াছি, 
রাখি ৫9 হইগাছে, অ কাশে একবার শরৎকালের মেধ ডাকিয়া উঠিল, চাহিয়া 
দের লাম, গাঁডেদ ম গের একগহাি মি হা প ডগ্জাছি | মুন্সী বলিল, কথায় 


০০০ 


[কৎ র পথ ফুলে এঠেভি। এবাৰ ক্ববেন? 


সস 


ৃ আন একট চছে|। 
1 আবার অগ্রস্ণ হইলাম । কিছুদূর যাইতেই একটা ঝাপটা £ ৯ 
আদিল, আমর! একটা প্রাচীন বইগাছের তলায় আছিঞা ফাড়াইলাম | নিকটে 
দূরে মানুয কোথা ৭ নাই । দরের পথের আলোগুলি এখান হইতে ঝাপসা 
দেখাইতেছিল। সেই নিজন বুক্ষভলে দাড়াইরা তাহার দিকে চাহিয়া বলিলাম, 
এত নিভর করেছ তুমি আমার ওপর, কিন্ত ধরো, আমি যদি তোমার সগ্রম 
রাখতে ন। পারি, মুন্ময়ী ? 
মুন্ময়ী বলিল, মানে ? 
এই ধরো, আমার প্রভাবে তুমি যদি নষ্ট হয়ে যাও? 
আবার আপনার সেই পুরণো কথা! আমি ত বলেইছি নষ্ট হ'লে ক্ষতি 
আমার নয়, আপনার । 
আমার ক্ষতি? কেন? 
নষ্ট হ'লে জানবো এ আমার বিধিলিপি, কিন্তু নষ্ট যে করে শাস্টিটা ত 
তারই পাওনা? 
হাসিয়া বলিলাম, তুমি এখনো ছেলেমান, এখনো কৌমাধ ভোমার 
পরিচ্ছন্ন, তাই বুঝতে পারলে না। ষদি তোমাকে আবার পথের ধারে ফেলে 
দিয়ে মুখ মুছে চলে যাই তবে কোন্‌ শক্তি আমার সেই নিষ্ুরতাকে বাধা দিতে 
পারে? কে আমাকে দেবে শাস্তি? 
মুন্ময়ী হাপিরা আমার হাত ধরিল। বলিল, আপনি বড়লোক, আর 
বড়লোকরাই অন্তায়কে অন্যায় বলে না। তবু শাস্ত আপনি পাবেন, আমি 
জানি। 


৬৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


কে দেবে সেই শাস্তি? হাইকোর্ট, না ভগবান? 

না, আপনি পিজে। 

বলিলাম, আছি নিজে? তুমি কিমনে করো তখন আমি অনুতাপ 
করবো? আমাকে তুমি এখনো চেননা মুন্ময়ী, নিজের কৃত অপরাধ আমার 
নিজেরই বেশী দিন মনে খাকে না । আর শাস্তি দেব নিজেকে ১» পাপকে 
পাপ বলেই আমি মনে করিনে। যে কোন অন্তায়কে একটা আকনম্মিক 
দুর্ঘটনা ব'লে ধনে করি, আর সেই র্যাকৃসিডেন্ট, ভুলতেও আমার দেরি হয় না। 

মৃন্মরী ভাঁপিয়া বলিল, নিজের বাইরের ধিকটাই আপনি চেনেন, ভেতরের 
দিকটা শয়। আপনার দিকে যখন চেখ তুলে চেয়েছিলুম তখন আপনার 
বয়ল তেরো আর আগার প্রায় দশ। বেশ মনে পড়ে শিবের গাজন গাইতুম 
দু'জনে গল| ধরাধরি ক'রে, কিন্তু মেয়েমানুষের প্রাণ পড়ে থাকতো পুরুষের 
প্রাণের দিকে । মোটাসোটা মেয়ে ছিলুম, আমার গায়ের গন্ধে আপনার 
নাকি নেশ। লাগতো, কিন্তু আমারও যে-চোখ খুলতো। সে-খবর আপনি 
ধাখেননি । যাক্গে সে কথা । আমি বশি আপনার বাইরের দেখাটা সত, 
। বন্ত ভেতরের দিকে আপনার চোখটা নেই । এবারে দীর্ঘ পাচ যান ধারে 
আপনাকে দেখলুম, বৈশাখ থেকে আশ্বিন,_বেশ দেখলুম, বাইরেটাই 
আপনার অপরাধ করে, নোংরা ঘাটে, কিন্তু ভেতরটা নর । তোষামোদ মনে 
করবেন না, আমি অত্যন্ত অহঙ্কারী বলেই সত্যি কথা বলি। বাইরেটা। 
আপনার কঠিন ব্বরতা দিয়ে ঢাকা, কিন্তু একট! দুর্বলতার ছিদ্র আছে সেট! 
আপনারও চোখে পডে না। 

বলিলাম, কি রকম? 

সৃন্ময়ী বলিল- বৃষ্ট ধ'রে গেছে, চলুন আর একদিন হবে। ওকি, 
ছেলেমানুষী করবেন ন]। 

সে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিতেই “ক্ত কবিয়া তাহার হাতখানা ধরিলাম। 
বলিলাম, বল কি বলছিলে ! 


৬ 


বড়েরু সঙ্কেত 


মৃন্ময়ী হাসিমুখে বলিল, টাকা কণ্ট| দিন আমি যাই? রাত হোলো যে? 

অধীর হইয়া বলিলাম, দেব না টাকা, আগে বলে] । 

বারে, এ অভ্যেনও বুঝ আপনার আছে ৮» গডেছু মাঠে অন্ধকারে 
গাছতলায় এনে মেয়েমান্ুবের ঝাছ্ছ থেকে টাকা ছিনিষে নেওয়া ? 

রুদ্ধ ণিশ্বাসে আমি বলিলাম, তার চেয়েও মন্দ অভ্যেস আমা অছে। 
আমাণ এই ধুতি পাঞ্জাবীর শীচে ধে-পানবের বাসা তাকে ভুমি এখনো 
চেনোনি 1 বলিতে বাঁলতে অন্ধকারে আমার গেগ জলিতে লাগিল, তাহার 
শান্ত নরম ভাতখান| ধরিয়া আমারই বজ্জনুঠি আতর উন্তেজনাধ পাপিতে 
লাগিল, পুনরায় বাঁললাম, আছে যাপার আগে তোথাকে বলে মেতেই 
হবে কোথার আমার সেই হিদ্র। 

অদ্ভুত একটি স্গেত্প হাসি মুন্সযার প্রসমমখে ফটয়া উঠিল । শান নিকুদ্ধি 
কে সে কঠিল, আচ্ছা বলভি, আগে ছাড়ুন ভাতখান। 2 আন এদিকে, 
বেড়াতে বেড়াতে বাঁল17--এই বশিয়া বাণে পারে সে হাতখান। ছাডাইয়া 
শইল | 

বেডাইতে বেড়াইতে সে পুনরায় তাহাপ বা হাতখানি দা আমার ডান 
হাতের নডাটা ধরিল। অধুন কগে কাল, গেহ ভেবো বঙ্ছরের লালক 

আপনি, তেমনি জেদী, তেগশি উদ্দ্রাপভর। । সংসারে কিছুঠ যখন 
আপনি পরোয়া! করেন না, দন্বুত্তির ভাঙনে াপশি যদি সব ল5গুই 
করতে চান্, তবে আমার এই শামান্ত কথাঠ শুনতে এত আগ্র 
কেন? ঘার আন্মবিশ্বাসের মূলে সংশরেদ বিষ ঢালা তান মুখে এত বড়াই 
কন্ত বেমানান । 

আমি এতক্ষণ পরে হাসিলাম। ব'লবাম, ৫২ এই তুমি বলতে চাইঙিলে, 
তারই এত ভনিতা? হাঃ ভাঃ হাঃ ভাহ। বেশ, আমি বাধিত । আমার 
'আত্মবিশ্বাসের মুলে সংশয়? একবিন্দুপত নর । জানো, আম কভিজনের 
সবনাশ করেছি ? 


মি 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মৃন্ময়ী বলিল, তারা বোধ হয় পুরুষ নগ্ন, মেয়েমান্ষ । 

আমি তাহার দিকে চাহিলাষ । *সে কহিল, মেয়ের! সর্বনাশের প্রতিশোধ 
নেয় না, পুরুষের অপরাধ তাবা৷ নিজে দর চোখেরু জলে মুছে দেয় । কেন জানেন? 
সকল পুরুষের জন্মই তাদের গে ৷ ূ 

চলিতে চলিতে ভাহার দ্রিকে চাহিয়া কুতিলাম। "মু্সযী পুনরায় কহিল, 
ববরের লোহার চাক আমাদের বুকের পর পিয়ে সহজেই চলে যায়, তার 
কারণ, পথটা] ত দুর্গন নয়, স্েঙে মন্ুণ। কিন তাদের দুরম্থপনাকে যদি 
ক্ষমাই ন1 করতে পারবে! তবে মেয়েমানষ হলুম কেন? । 

মনে হইল তাহার চোখে জল অঃসিঘ়াছে । মাঠের প্রান্তে দ্রেগদাবের 
মাথার উপর কুঞ্কায়া রাত্রির কপালে তারাদলের দিকে আমার চোখ পড়িল। 
যে-কারণে ভাহার চোখে এই অশ্রুর আভাস তাহা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নহে, 
এই পথবাসিনী তরুণী নিজের দুঃখ ও দুযোগ ভুলিয়। বিশ্বে সমগ্র নারীজাতির 
অন্তরের বিচার এই ভাবেই করিয়া চলিগাছে। পুরুষের অনাচারের প্রতি 
তাহার এই অনীম বাৎসল্যের অত্যাশ্চব প্রকাশ দেখিয়। আমি কেবল বিশ্মিত 
হইলাম না, উপবে ওই তারকার জাজ্প্যমান চক্ষে তৃষ্চাতরা নিশীখিনী যেমন 
করিয়া কাপিভেছে, আমিও অমনি করিয| থবখপ্প করিতে লাগিলাম । প্রবৃত্তির 
শতপাকে সহজ্র গ্রন্থিতে নিজেকে আমি জড়াইয়া রাখিয়াছি, বাসনার অগ্রিকুণ্ডে 
ইন্ধন ঘোগাইয়া চলাই আমার নিত্যকর্ম পদ্ধতি, কিন্তু আজ যে-নারী আমাকে 
অনীম ব্যাপ্ির দিকে টানিয়া লইয়া যাইবার জন্ত আমার বন্ধনগ্রন্থি 
কাটিতে লাগিল, তাহাকে অভিনন্দন জানাইবার ভরসা পাইলাম না” 
চারিদিকে নিরাশ্রয় অকুল সমুদ্র দেখিয়া ভয় পাইতে লাগিলাম। আমি 
মনে মনে যেন প্রাণপণে নিজেকেই আকৃড়াইয়া ধরি আত্মরক্ষার চেষ্া 
করিলাম । 

ধর। গলায় ধীরে ধীরে বলিলাম, বাড়ী চলো, মুন্ময়ী । 

মুখুয়ী শান্তকণ্ঠে কহিল, চলুন। 


৬৮ 


ঝড়ের পঙ্ষেত 


কিন্তু তাহার .যাইবার লক্ষণ ন1 দেখিয়া আম্মবিস্থত হইয়া! চলিতেই 
লাগিলাম। কিছুদূর গিদ্া মে কহিল, রোগের একটি বীজাণু শরীরের সমগ্র 
রক্তকে দূষিত করে, মানেন ত? 

বলিলাম, মানি । 

মৃণুয়ী পুনরায় কহিল, উপমা উল্টে নিন্। একবিন্দু পুণ্য সমস্ত পাপকে 

ংস করার পক্ষে যথেঞ্ এগ আপনাকে মানতে হবে। 

কিন্তু আমি যে চিরজীবন নোংরামি কবে এসেছি, মৃণ্ময়ী ? 

মুঝ্ন্দী বলিল, কোন ক্ষতি হয়নি | 

কী বলছ তুমি? 

বলছি, মানুষ সত্যিই অনরু, এ শাপনি বিখাম করুন । উপরের দিকট! 
প'চে গ'লে ক্রেদাক্ত হদে গেছে, কিছু িতরেদ দিকে চেয়ে দেখুন অগ্রিখষি 
আগুনের কুণ্ডে ধ্যানে বসে বয়েছেন, ভাব মুহা নেই | বারে বারে দাউ দাউ 
”রে জ'লে উচ্ে তিনি জ্বালিতধে দেন সকল ধাহা অপরাধ আর ঙ্লন-পতন। 
ভয় কি? আপনার আম্মবিশ্বাদের মুল যেলংশয়ের ছিদ্রপথ, সেই পথেই যে 
নহৎ চিন্তার আনাগোনা । মামুন কখনো মরবে? সেযে দেবতা! ক্রেদকরিন্ত, 
বাওৎস, লো ভলালন। ছর্গব, ঢষ্টব্যাপিগ্রস্থ,সব জালিষে পুডিয়ে সেই দেবাম্া 
এক সমন্ন দেবসেনাপতির মতন বেবিঘথে পড়ে _মুগ্মতী বলিতে লাগিল, 
এ আমি দেখেছি, উপ আদি জন্থর মতন লুকিয়ে থাকি, তার 
চারিদিকে দেখেছি এর নিত্য উদ্বাহবণ | মানব নখরও নয়, মানুষ 
পাপীও নয় । 

কেমন যেন ভারাক্রান্ত ঘনে ছুজনে সেদিন থাঠের পথ ছাড়িয়া রাজপথের 
উপরে আসিয়া পড়িলাম। পথের আলো গাচী-ঘোড়া ও জনসমারোহ দেখি 
আমি যেন কূল কিনারা খুঁজিয়। পাইলাম । হাপ ছাড়িয়া বাচিলাম। 

মুগ্ময়ী এতক্ষণ পরে সহজ কগে হাসিল। বপিল, শাদ্দে বলেছে, মোহিনী- 
মায়া, আপনি এতক্ষণ তারই প্রভাবে পড়েছিলেন, না রাজেনবাবু ? 


৬৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমিও হাসিলাম। বলিলাম, মোহিনী-মায়! নয়, এতক্ষণ ভূতে পরেছিল! 
এ ভূত আমাকে ছাড়াতেই ভবে । 

ছাঁড়ালেই পালাবে, ভগ্ন নেই। কিন্তু সাবধান, আর যেন অশাদাড়ে- 
অন্ধকারে বেরোবেন না, তাহলেই আবার ধরবে । 

গাড়ী ভাড়া করিয়া! ছুজনে চড়িরা বসিলাম। মুগ্মরী বপিল, যাই বলুন, 
মেয়েমানুষ আরাম চায়, গাড়ীর গদিতে বসে বাচলুম। চলুন, আপনার ঘে 
দিকে খুশি । 

হাসিয়। বলিলাম, ঘদ্দি পাতালপথে নিযে যাই ? 

বেশ ত, কিন্তু মাঝ পথে থামতে দেবো না, একেবারে শেষপ্রান্ত পরস্ত নিয়ে 
যেতে হবে। 

কেন? 

মুন্ময়ী বলিল, আমি জানতে চাই আপনার ক্ষুধা ছুর্বলের নয়, দানবের | 

বলিলাম, মুন্ময়ী, জানাতে তোমাকে পারতুম আমি কী। কিন্ত 

সে কহিল, কী আপনি, শুনি ? 

আমি? নিজের গুণের কথ! নিজের মুখে বলতে নেই । তবু ঝলে রাখি 
হিংস্র জানোয়ার আর বর্বর দস্থ্যর একট] সংমিশ্রণ আমার মধ্যে পাই । শুনে 
ভয় পেয়ো না। 

স্বাসিয় মৃন্য়ী বলিল, ভয় পাবো?» জানোয়ার যদি হয় নরসিংহ আর দস্যু 
বত্বাকর হয় মহাকবি বাল্ীকি, তবে কেমন লাঁগে ? 

বলিলাম, তুমি কি আমাকে কিছুতেই ছোট ক'রে দেখতে পারো না? 
একটু ভালোবাসো আমাকে, নয়? 

মুন্য়ী সহসা! আড়ষ্ট হইয়া গেল। স্তব্ধ হইয়া বসিয়া র্ৃহিল। চলস্ত 
ফীটনের ভিতরে তাহার মুখের চেহারাটা! আমি দেখিতে পাইলাম না। এবং 
তাহার মনোভাব ঠিক বুঝিতে না পারিয়া আমিও একটু যেন সম্কৃচিত হ্ইয়। 
গেলাম। ইহা বরাবরই দেখি ভালবাসার কথ! উঠিলেই সে যেন কেমন হ্ইয়! 


৭০ 


বড়ের সঙ্কেত 


যায়, তাহার চেহারট] পাষাণের মতো হইয়া আসে । হয়ত একথা আমার ন্যায় 
মহাপুরুষের মুখে সে শুনিতে চাহে না। 

কিছুক্ষণ পরে বলিলাম, হ্যা, যা বলছিলুম । তোমাকে জানাতে পারতৃম 
আমার সত্য চেহারাট। কিন্ত 

মুন্ময়ী নড়িয়া বপিয়৷ সহজ কগে কহিল, কিন্তু কেন? 

বলিলাম, বাধা অনেক। ছোটবেলা থেকে তোমাকে জানি, সরোজিনী 
নাপিমার মেয়ে তুমি, আমরা তোমাদের গ্রামের ঘর জালিয়ে উৎপাত করেছি, 
বাবার সঙ্গে তোমার স্বর্গতা মায়ের অমন একট। অদ্ৃত প্রণয়ের সম্পর্ক জানতে 
পারলুম,_বহু কারণে তোমাকে অপমান করতে আমার হাত গুঠেণি। অনেক 
সময়ে মনে হয়েছে তোমার সনম রক্ষার একট! দায়ত্বও বুঝি আমার নেওযা 
উচিত । 

সে বলিল, সেই দায়িত্বরক্ষার জন্যে বুঝি সিনেমার ফাদ পেতেছিলেন ? 

সিনেমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি? 

উষ্ণকঠে নে কহিল, সিনেমা কোম্পানী খুলে মেয়েছেলেদের নিম্নে কাদ। 
ঘাটলেই বুঝি আমার মানরক্ষা হোতে। ? 

বলিলাম, অবাঁক করলে তুমি, মৃন্মবী। তোমার মান কিসে থাকে আর 
কিসে যায় এ ত" আমি বুঝতে পারছিনে ? 

বুঝবেন একদিন । 

কবে? 

যেদিন আমি থাকবো না। বলিয়া এক ঝলক হাসিয়া মুন্সী টুপ করিয়া 
গেল । 

উদ্দিগ্ন হইয়া বলিলাম, থাক্‌বে না? কোথায় যাবে? 

চুলোয়। যেখানেই যাই না কেন, আমার গতিবিধি আপনার শুনে কি 
লাভ? 

তোমার সঙ্গে এতক্ষণ বেড়িয়েই বা আমার কী লাভ হোলো, বল দেখি? 


৭৯ 


বড়েবু সঙ্কেত 


মৃন্সয়ী বলিল, আমি না থাকলে এতক্ষণ আপনি অবশ্ই কোথাও নোংবা 
ঘাটতে যেতেন, কিন্বা গিয়ে ঢুকতেন ধন তলার সেই মদের দৌকানটায়, কিন্বা 
কোনো সিনেমা-খিয়েটারের ত্বাস্তাকুডে। 

বলিলাম, বলেছ তুমি ঠিক 1 তবে ওসব জায়গার লাভ-লোকসান দুই-ই 
হোতো, সময়ের বাজে খরচ হভোতো ন। 

বড় বড চোখে চাহিয়া মৃন্ময়ী বলিল, কাল থেকে শিশ্চয়ই আপনার অমূল্য 
সময় সেইখানেই ব্যরর করবেন ? 

তা একরকম বটেই ত। 

মুন্যয়ী কহিল, কথায় দ্বিধ! কেন? 

বলিলাম, যেয়েদের কাছে সত্য কথা বলতে ছিধা একটু হয় বৈকি । 

সে কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া বুহিল তারপর বলিল, একটি কথা ত্াপনাকে 
বলব? কিছু মনে করবেন না? 

কথাট। কি জাতীয় শুনি? আমাকে লীতিশিক্ষা দেওয়। ? 

না। আপনাকে সতর্ক করে দেওয়|। 

তাহার কথায় রস পাইয়া সাগ্রহে বলিলাম, সতক ক'রে দেঘা আমাকে ? 
কি বলো ত? 

মৃন্মরী বলিল, আপনি যদি আজ থেকে সমস্ত বদ অভ্যেসগুলো ত্যাগ 
করতে পাবেন তবেই আবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। 

সে ত” আনার পক্ষে সম্ভব নয়, মুন্য়ী | 

তা হ'লে আমাদের এই দেখাই শেষ, রাজেনবাবু। 

অতি উত্তম কথা । এই গাড়োয়ান-_- 

ক্যা বাবু? 

সুন্ময়ী উত্তর দিল, কুছ নেই, ঠিক হায়, চলো । 

আমি আহত নতমুখে অনেকক্ষণ চুপ করিয়৷ রহিলাম। তারপর সহসা কুক্ষকঠে 
বলিলাম, মুন্ময়ী, তোমাদের মতন মেয়ে পথে ঘাটে কিনতে পা ওয়া যায়”ত। জানো? 


৭২ 


ঝড়ের সঙ্হেতি 


মুখায়ী বলিল, যায় কি না জানিনে, যদি যায় তবে একটু বেশি দামই লাগবে । 
কিন্ত যেকুপণ আপনি । 

রূপণ বটে, তবে বূপবতী মেষের সম্পর্কে নয়। 

রূপ কি আর আপনি চিনতে পারেন? যে-কুচি আপনার । 

আমাব রুচির উপর কাহার কটাক্ষ আমি কোনোঁকালেই সহা করিতে 
পারি না। আমার ভিতরটা একবার কেশর ফলাইয়া গঙ্জিয়া উঠিল। কিন্তু 
এই সামান্তা নারীকে অসম্মান করিতে আমার মন উঠিল না, সাহসেও কুল!ইল 
না। ীধণ আক্রোশ অতি কষ্টে দমন করিয়া কেবল শাম্তকঠে বলিলাম, 
রুচির প্রশ্ন তলে আব কাজ নেই, কারণ তোমার মাকেও জেনেছি, তোমাকেও 
দেখেছি | 

মনে কন্দিঘাচিলাম তাহাকে অপমান করিবার পক্ষে আমার এই জঘন্ত 
কটাক্ষই যথেছগ, কিন্ছ আমার বুদ্দিহীন শিবদ্দিতাতা ইভার অন্যদিকট। বিবেচনা 
করে নাই। সেই দিক ভইতেই মুখ্নী এক কথায় আমাকে একেবাবে পথে 
বপাইবা দিল । হাসিগুখে বলিছা উঠিল, আমার মায়ের স্বাভাবিক কাল্চার 
আব রুচি অতি উটদবের ছিল, দেই জগ তিনি 'সাপনার বাবার মতে! একজন 
রূপবান আরব শিক্ষিহ বাক্তির প্রতি আংসল্ড তযেছিলেন। আপনা বাবা 
ছিলেন সাধারণ পুরুষ । যছি9 আপনার! আমাদের ঘরু জালিয়ে দিয়েছিলেন, 
এবং সে আপনাব মায়েরই হুকুমে, কিন্ত আমার ঘা জানতেন আপনার বাবা 
তার কত আপন, কত আনেন । আব আমারু কচির কথা? আমার অবশ্য 
আপনি নিন্দে করতে পারেন তবে 

মুগ্মদী উজ্ভল হাসি হাসিব] সাভার বাকি কথাটকু প্রকাশ করিল। 

মার খাণয়া কুকুরের মতো শেষ কামড না দিনা আর থাকিতে পাবিলান 
না। দুর্বলের মুখে যে কথাটা সর্বাগ্রে আসিয়া হাজির হয় তাহাই প্রকাশ 
করিলাম. বেশ, তোমাদের রুচি না ভয় খুব উন্নত মানলুন। ক্িন্ধ নীতি 

দুর্নীতির দিক থেকে? সেদিন থেকেও কি তোমরা সীতাসাবিত্রী ? 


৭৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মুনয়ী কহিল, ভূতের মুখে রাম নাম! সীতা-সাবিত্রী আমর না হই, 
.দ্রৌপদীও ত বটে। দেবী হিসেবে দ্রৌপদীই বা কম কিসে? সত্যিকার 
ভালবাসার ব্যাপারে নীতি ছুর্নীতি বড় কি না জানিনে, তবে-_ 

তবে কি, বলে। ?--আমাঁব আগ্রহ বাড়িয়া গেল। 

মন্র কথা যদি বলি আপনার ভাল লাগবে ন1। 

বলিলাম, মৃন্ময়ী, মনের কথা.যদি কঠোর হয় হোক, কিন্তু সত্য হলেই ভাল 
লাগবে। 

' মুখয়ী বলিল, জানি মেয়েমীনুষ ভালবাসার কাগাল। এও জানি নিরাশরয় 
মেয়েমান্থষের মন স্সেহের আশ্রয় চেয়ে বেডায়, কিন্ত ভালবাসার ব্যাপারটায় 
খুব _একটা বড় মহিমা আছে ঝলে আমি মনে করিনে। জীবনে এর দাম 
বড় কম। 

তোমার কথার অর্থ কি মৃন্ময়ী ? 

গাড়ীর বাহিরে পথের দিকে চাহিয়া মুন্ুয়ী বলিল, এই পরুন, আমার 
জীবনটা অত্যান্ত হুর্ভাগ্যের, কিন্তু যে ছুঃখট] নেই, সেই ছুঃখকেই ঘরে ডেকে 
আনবো এমন ভূল কখনো যেন না করি । আমার পথের জীবন যেন পথেই 
শেষ হয়ে যায়। 

আমি সহসা তাহার কাধের উপর হাত বাখিয়। বলিলাম, মুন্ময়ী, পৃথিবীতে 
সকলের বড় সত্য যা, তাকেই তুমি জীবনে অস্বীকার করতে চাও? 

আমার হাতখানা ধীরে ধীরে আমারই কোলের উপর ফিরাইয়! দিয়! মুন্ময়ী 
বলিল, আমার জীবন খুব সামান্য, আসন খুব ছোট,_তবু তাকে অস্বীকার 
আমি করতে চাই । আমার চোখ অন্ত দিকে, হয়ত দূরের দিকে, হয়ত আমার 
প্রাণপদ্ম চেয়ে রয়েছে আকাশের অসীম ন্বপ্নলোকের দিকে, যেখানে কৃষ্যের 
ঘন অন্ধ নিগুঢ আলো-আনন্দের প্রাবন,_হয়ত এমনও হতে পারে আমি 
মানুষের কাছে কিছুই চাইনে, কিছুই আশা করিনে, স্বধু যেন যাবার সময় 
সকলের দিকে চেয়ে স্সেহের হাসি হেপে যেতে পারি। 


৭8 


বড়ের সঙ্কেত 


কেমন একট] ভাবাবেগ হইল । প্রিয়জনের সহিত চিরবিচ্ছেদের সম্ভাবনায় 
যেমন একট] উচ্ছৃদিত ব্যাকুলত৷ দৃই হাত বাড়াইয়া কাঁদিয়া উঠে, আমি যেন 
তেমনি করিয়াই মুন্প়ীর দিকে হাত বাডাইতেছিলাম, কিন্তু নিজের হাত 
খানাকে সংযত করিলাম | কথ! বলিতে পারিলাম না। 

(মৃন্ময়ী বলিল, ভালবাসার সঙ্গে জড়ানো থাকে মস্ত বড় লোভ, মস্ত স্বার্থের 
কামনা, তাই তার সঙ্গে থাকে দুঃখ, যন্থণা, নিরাশা, অসম্মান । নিদঘ্স নিন্দায় 
আর কুংসিত ক্রেদে প্রাণের ক্ষেত্র ভরে ওঠে, তার পর একদিন অশ্রুর বন্যায় 
তার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়। আমার মা আর আপনাব বাবার জীবন এর চরম 
উদাহরণ, আজ তাদের আত্মার শান্তি হয়েছে বোধ হয়| রাজেনবানু, আমি 
আবার সেই ভুল করবো? যেজন্ধ ঘুমিয়ে আছে তাকে খুচিয়ে জাগাবো ? 
আহার দেবো কোখেকে ? 5 

বলিলাম, মুন্মধী, সংশিক্ষা আর কালচার আমার নেই কিন্তু পণ্ডিতদের 
বিচারে বোধ হয় তোমার কথার একটা তুল থেকে যাচ্ছে! তোমাকে নীচে 
নেমে যেতে আমি বলিনে, ভালোবাসার জন্তে ছুখ পাও তা৭ আমার ইচ্ছে 
নয়, কিন্তু হয়ত সব ভালোবাসার পরিণতি চুঃখে নয়, দুঃখের ডিতর দিয়ে অসীম 
আনন্দলোকের দিকে । 

এমন কথা আমার নোংরা মুখ দিয়া বাহির হইবে ইহা আমিও ভাবি নাই । 
আমার সকল তুষ্কৃতির মূলে সংশয়ের ছিদ্রপথ আছে মুন্সীর এই কথাটা আমান, 
মনে পড়িল। কিন্কু আমার কথাটা শুনিয়া মে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া আমার 
মুখের প্রতি চাঠিয়া রহিল। তাহার একান্ত চাহনি দেখিয়া আমি লজ্জায় 
মাথা নত করিলাম । আমার মনে হইতে লাগিল, আমি তাহারই চিগ্কাধারার 
ব্যর্থ অনৃকরণ করিয়াছি । . 

অনেকক্ষণ পরে নিশ্বান ফেলিয়া মুগ্রী কথা কহিল। বঙ্গিল, কি জানি, 
হয়ত আমি আজো চিনিনি নিজেকে কিন্ু আমার ভাইরা, আদার বোনেরা, 
যাদের বুকের মধ্যে পরাধীনতার অদীম যন্ত্রণা, যাদের হৃদয়ে বিশাল কল্পনা, 


৭৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ধাদের জীবনের বিরাট আদর্শ হিমালয় থেকে কন্তা-কুমাপ্রিক। পর্যন্ত সংহত 
জাতীর়তার মহান্‌ স্বপ্ন, আমি যেন তাদের ভালোবেসে যেতে পারি। আমার 
চিরছুঃখিনী দেশ জননী, আমার সন্তানদল-যারা দেশের দুর্গম অন্ধকারে 
উপবাপে শীর্ণ, যার ব্যর্থপ্রাণ, ক্ষমক্ষীণ- আমি যেন এদের সবার কিছু উপকার 
কবে যেতে পান্িি। হযদ্দি নাও পারি কিছু, তবে তাদের জন্তে আমার চোখের 
জলের অভাব কোনো দন ন] হয়! 

আমাদের গাড়ী চওড়া ব্াস্ত। ছাড়িয়া সরু পথে ভাটবাজারের ভিড়ের ভিতর 
দিয়া প্রায় আসিঘা পড়িয়াছে। সেই নোতংর। বস্তির কাছে মৃণ্মঘীকে নামাইয়। 
দিতে হইবে এই কথা এতক্ষণ পনে মনে পড়িতেই আম আড়ষ্ট 
হইয়। নি তাহান্ন এই হতশ্ী জীবনযাত্রাটা যেন আমারই 
আত্মন্মীনবোধকে বারম্বার আঘাত করিতে লাগিল। কিন্ত তাহার সহিত 
আমার সম্পর্কটা এমনই অসম্ভব যে, নিরুপায় ভইর। আমি ৮প করিয়া 
বহিলাম । 

কাহাকাছি আসিতেই মুগ্মঘী হাসিয়া বলিল» আপশার দিনেম। কোম্পানীতে 
চাকুৰি নিতে গিয়েছিলুম একথা মনেই ছিলেন নাগ_আমাকে গিয়ে এখুনি 
রান্না কনে দিতে হবেঃ ত1 জানেন ?--এই বলিয়া সে গারের কাপড় সংঘত 
করিল, কানের ছুল্‌ খুলিল, মুখের রুজ-পাঁউডার বেশ করিয়া মুছিয়া ফেলিল, 
পরে বলিপ, চাক্রীর লোভে কী সঙই সেজেছিলুম 

বলিপাম, চাকরির লোভ ত” তোমার ছিলনা, আঘাকে সংপথে ফেরাবার 
আগ্রহ ছিল। 

ফেরাতে পারলুম কই,_এই গাড়োয়ান, দাড়াও । 

গাড়ী থামিতেই তাহার ভ্যানিটি ব্যাগ তৃলিরা বলিলাম, তোমার টাক 
নিয়ে যাও, মৃন্মধী । 

মুন্নী নামিয়া গিয়া! কহিল, টাকা? টাক। আমার কী হবে? 

বলিলাম, সে কি, তোমার ভাই-বোনরা, সন্তাশরা_ 


৭৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


গাড়ীর ভিতর মুখ আনিয়া নে হাসিমুখে বলিল, আপনিও ত" তাদের 
দশের লোক, -টাকা আপনাকেই দান করুলুম । তা] হাঢা টাঞ্চা যে 
আপনা বড় প্রিন্ধ। 

আহত হইয়া বপিলাম, কিন্ত ভোমাত্র টাকায় আমার কোনে। অধিকার 


মুন্মযী বলিল, বেশ ত”, লঠ কর! টাকা ডাকাতিতে ই খরচ করবেন। 
আপনিই ত” বলছিলেন টাকা খবুচ করলে আমার মতন মেখে পথে খাটে 
কিনতে পাওর। যায় । ওই টাকার তাদ্রেই কিনবেন। 


আমি অপমানিত মুখে স্তন্ধ হইয়া রহিলাম, মুন্সী মুখ কিনাইয়া সেই 
ইতর বপ্তিটার অন্ধকার কুডর্ঈপখে অদশ্ঠা হইয়া গেল । আমান গাড়ী ফিরিঘা 
চলিল্‌। 
ছয় 


বাত্রে থুম ভাঙিয়া গেল। ঘরে আলো নাই, অন্ধকারের টিতরে 
চাধিদ্রিকে আমার দুষ্টি ঘুরি বেভাইতে লাগিল । অনেকদিন এমন হইয়াছে, 
রাত্রে হঠাৎ উঠিয়া কিছু টাকা হাতে লইয়া বাহিনু হইয়া গিয়াছি, পিতানাতাকে 
গ্রাহহ করি নাহ, আবার ভরত রাত্রিশেষে কিপিয়া নিঃশন্দে শিছের ঘরে 
ঢুকিয়া আমার চৌর্ঁবৃন্তিকে গোপন করিয়াছি । আমার ক্ষণপ্রনুন্ভিকে ইন্দন 
যোগাইয়া একরূপ আব্ররিক আনন্দেই আমি প্রজাপতির মতো! ঘুরিয়। 
বেডাইতাম । 

আজ গুপ্ু অন্ধকারের তলায় লুকাইয়া স্হসা প্রশ্থ করিলাম, আমার কি 
হৃদয় আছে? সৃনুয়ী আন্মদান করিতেছে, তাহাকে গ্রহণ কনিতে পাঁরিতেছি 
না কেন? লুব্ধ বাসনা লইয়া তাহার নিকট গিয়া ধাড়াইতেছি, হাসিমুখে সে 
অভ্যর্থনা জানাইতেছে ; কিন্ত রূপ-যৌবনের প্রতি আমার স্বাভাবিক ক্ষুধা 


৭৭ 


বাড়েন সঞ্চেত 


কেমন করিয়া হারাইলাম? যাহাকে পাইবার জন্য আমার কোনে পরিশ্রম 
অথব। উদ্বেগ, নাই, স্বেচ্ছায় আদিরা যে আমারই নীড়ে আশ্রম্ম লইতেছে, 
তাহাকে পাইতে গিয়া আমার বিবেকে বাধে কেন? তবে কি আমার হৃদয় 


আছে? 

কিন্তু অন্ধকার বাত্রির নৈঃশব্দ আমার প্রশ্নের জবাব দিল না, শিজেণ বুকের 
ভিতরে ৪ আমি যেন কেমন একটা ঘন অন্ধকারের গুরুভার উপলদ্ধি করিলাম । 
আমি নিছে কোনোদিন কাহারও ভালে। কৰি নাই, কিন্ত আমার জন্য একটি 
নারী শিশিদিন কল্যাণ কামনা করিতেছে, ইহা ভাবিভে গেলেই আমি থেন 
যন্ত্রণ। অনুভব করি । স্বা্থীনত। ও স্বেন্ছাচারের ভিতরে খাকিয়া আমার এমনই 
হইয়াছে যে, ভাগবাপার বাধনে ধরা দিতেও আমার বুকে ভিতরট। ভয়ে 
কাপিতে খাকে। আমার কেমন একটা ধারণা আছে, প্রয়োভন হইলে 
আসন্তিকে বঝং হাগ গণিতে পাধিব কিন্তু ধদদ্ধের কোনে মহৎ সুরের ফাঁদে 
পড়িলে আমার এই শান্তি আর থাকিবে না। অসংযমে কোনো বিপদ নাই, 
ব্যক্তিগত মুভির দ্বার সেখানে অধাঞ্ত, কিন্তু নানীর গ্খ-দুঃগ্ আনন্দ- 
বেদনার সহিত জড়িত হইর। পড়িলে আমার পলাইবার কোন পখ থাকিবে না। 
হৃদয় লইয়া কারুবাণ কাণিলে বাত্রপ নিশ্চিন্ত নিদ্রায় আনার ব্যাঘাত 
ঘটিবে। 

কিন্তু এ কোথায় আপিয়। পড়িরাছি? শরতকাল চলিয়া গেল, হেমন্ত- 
কালের বাতাসে কেমন যেন মুছু শৈত্য অনুভব করিতেছি । দেখিতে দেখিতে 
ছুই তিন মাস চলিয়া গেছে, অ।গেকার জীবন আমার নিকট যেন বিদায় 
লইবার জন্য চক্ষের সম্মুখে দাড়াইরা আছে, আর তাহাকে ধরিয়া রাখিতে 
পারিতেছি না। আমার একটা ছায়া যেন এই অন্ধ ঘরের ভিতরে ওই দেয়ালের 
কাছে দাড়াইয় গুপ্ত ঘাতকের ছুগির ফলকের গার নিঃশবে হালিতেছে। 
আমি স্তৰ হইয়া তাহার দ্বিকে চাহিগা দোখি, তাহার মুখে অদ্ভুত বিদ্রপ, আমি 
যেন তাহাকে এতকাল ধরিয়! প্রতারণ! করিয়াই আসিয়াছি; আমার সত্তার 


৭৮ 


ঝডেনু সঙ্কেত 


সহিত তাহাকে য়ে চিরকালের জন্য মিশাইয়া লইতে পারি নাই, এই ফাকি 
সে যেন আজ ধরিয়া ফেলিয়াছে | 

চোখ বুজিয়া পাশ ফিবিলাম। 

কিন্তু চোখ বুজিলেই আরও ষেন দূরের দিকে দুষ্টিটা ছুটিয়া যায়। চাহিয়া 
দেখিলাম চৌরঙ্গীর পথ ধরিয়া চলিয়াছি । মাঠের ভিতর দিয়া মুন্ময়ী আমার 
পাশে পাশে চলিতেছে । বে কথাগুলি তাহার নিকট শুনিয়াছি, আহার 
ম্মপেক্ষা অনেক বেশি উপলব্ধি করিয়াছি । তাহার ভর এন ৪ পরিচ্ছম কচির 
উপরে কত অত্যাচার অবাধে চালাইয়। গিয়াছি তাত মনে করিলেও মাথা হেট 
হয়। আমার ভিতরে কোথায় মে একটা বড সম্ভাবনা দেখিয়াছে যাহার 
জন্য সে আমাকে পদে পদে মা করিতে দ্বিধা বোপ করে লাই। 
টাকা দিয়া তাহাকে অনেকবার বাচাইরাছিঃ মনে কারিভাম টাকার জন্য সে 
নামার পিছু পিছু ছুটিতেছে, কিন্তু সে-ফলল আমার ভয়াঙে। আমার 
হ্যায় কপণ ও লোভীর নিকট অসস্কোচে সে এতগুলি টাক। অগ্রান বদনে রাখিয়া 
দিল, এই টাক। লইয়া আমি যথেচ্জাচার করিতে পারি শানাইয়। গেণ, কিস্তি 
কোখাও এতট্রকু আপাক্ত প্রকাশ করিল না। 

চোখ বুজিয়া দেখিপান, ঘুন্মরী কখন্‌ হইর। উঠিয়াছে জ্যোতিন সী । দেখিলাম 
সে আমার কাছে নাই, অনেক দুখে দাঁডাহইদলা সে যেন শ্মিতমুখে আমাকে 
বলিতেছে, ভর কি? তোমার বুকের মধ্যে অগ্রিপ্াধি আগ্তনের বুগ্ডে ধ্যানে বসে 
রয়েছেন, তার মৃত্যু নেই । ধাপে বাবে দাউ দাউ কপ জলে উঠে তিনি জালিয়ে 
দেন সকল বাহ অপরাধ, আর খলন-পভন | মানব কখনও মে ? সে যে দেবতা ! 

মুগ্মরীর দিকে চাহিয়া দেখিলাম, যে-অছুত কামকল্পন। তাহার সবাঙ্গ ব্যাপিয়া 
আমার লাঁলসা-জর্জর জৈবৈ-প্রবৃত্তিকে ক্ষণে ক্ষণে মাতাল করিয়াছে, কেমন 
একট] মন্ত্রবলে তাহ! দৈবভাবে প্রতীপ্ত হইয়া! উঠিরাছে। ইহা কি আনারই 
দেখিবার ক্রটি? নারীর একই রূপ চিরদিন ধপ্দিযা পুরুষের চক্ষের সম্মুখে 
দাড়াইয়া :আছে, কিন্তু তাহ! কি সত্যই ভিন্ন রূপ ধারণ করে? কেহ 


৭৯ 


ঝড়ের সন্কেত 


তাহাকে দেবী বলিল, কেহ বলিল কবিতা, কেহ বলিল দানবী, কেহ বা 
নিতান্ত মানবী বলিয়। তাহাকে ঘরে তুলিয়া লইল। কিন্তু আমি ত' ভাহাকে 
কোনো আখ্যাই দিই নাই, তাহার কোনে বূপই শ্বীকার কন্তি নাই, কেবল 
আমার দুণ্পরকুতির ইন্ধন হিসাবেই তাহাকে ক্রীডনকের যতোই ব্যবহার 
করিয়াছি । কি জ্যোতিময়ী ষাহাকে বলিলাম নে কেমন করিরা জ্যোতিমকী 
হইয়। উঠিল, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। নিজের দষ্টির উপর হইতে 
বাসনার জাল সরাইয়া দেখিলাম, আাচাধ যে অপরের চারিদিকে আমি 
ভ্রমবরের মতো গুঞ্জন কনিরাছি তাহাতে ফুটিল অমুত্মরী বাণী, 
তাহার যে চক্ষে ফুটিতে দেখিয়ান্ি আমান দুবন্ত স্বপ্রচ্চায়া তাহা যেন কেমন 
করিয়৷ অত্যাশ্র্য প্রসন্ন েভে পৃথিবীর সকল মানুষের দিকে চাহিয়! আছে, 
তাহার অপরূপ দেহলতা নমন্তা প্রতিমার মতে! মনে হইতে লাগিল । ইহা 
ৃষ্টিবিভ্রম সন্দেহ নাই, ইহা আদার শিদ্রান্তীন রাত্রির বিকার-কল্পনা তাহাও 
মানিলাম, কিন্ত 'আজ এমনি করিয়াই তাঁহাকে ভাবিতে ভালো লাগিল । 

সকাল বেল। উঠিস্বা! চারিদিকে চাহিপান । এমন করিয়। মার কোনোদিন 
ক্লান্তি অনুভব করি নাই । চোখের ছুই পাতা নিদ্র। জাডত, কিন্ত ভিতরে মন 
জাগিয়। থাকিয়া যেন খ। খা করিতেছে । তাহাকে খুম পাড়ানো সহজপাধা নয়। 

সকালের হাল্ক] রৌড্রের আলো ঘরে আসিয়া পড়িয়াছে, কিন্ত তাহা 
বিবর্ণ আমার জীবনের মতোই অথহীন। চিরদিন আমি সৌখীন, বিলালী-__ 
ঘরের আসবাবসজ্জ। তাহারই পরিচয় দের, আজ যেন সেগুলি সমস্তই গুরুভার 
বলিয়া মনে হইল । কি কারণে স্তব্ধ হইয়া এতকাল ধরিম্বা যে তাহারা আমার 
চক্ষের সম্মুখে দাড়াইয়া আছে তাহার কৈকিয়ৎ খুজিয়া পাইলাম না। তাহাদের 
প্রাণাদের প্রাণ ছিল বলিয়াই তাহাদের চেতনা ছিল, আমার মন কিরিয়া 
দাড়াইলেই তাহাদের অর্থ খুজিয়৷ পাওয়া যায়। 

মনে করিয়াছিলাম কাজ করিব, নিজেকে ভূলাইব, এই একটা অনির্দিষ্ট 
জীবনে যা হোক একটা সঙ্গতি আনিব। কিন্তু মুন্ময়ী সিন্মো-কোম্পানী 


৮৪৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


ভাঙিয়া দিল, আমার সকল কাধকল্পনাকে ছুই কথায় উড়াইয়া দিল, আমার 
এই উদ্ভ্রান্ত জীবন কেমন করির1 কাটিবে তাহার কথা সে আদৌ চিন্তা 
করিল না। আমার সকল দরজ! বন্ধ করিয়! দিয়! এক দিকের দুয়ার কেবল 
খোল! রাখিল। আমি ভালো হইয়া উঠি তাহাই সে চায়, আমি মন্দ হইয়া 
যাই তাহাতেও সে বাধা দ্বিবে না। আমি যাহা কিছু করিব তাহাই সে 
নিঃশবে চাহিয়। চাহিয়া দেখিবে, আমি অধঃপতনেপর পথে চলিলে সে আসিয়া 
নিষেধও জানাইবে না । স্তরাং সকালবেলার উঠিয়া! সর্বপ্রথমে এই চিন্তাই 
আমিল, আমি মানুষের মতো মানুষ হইব, অথব। প্রবু্তির প্রবাহে গ। ভাসাইয়। 
দিব। মুন্ময়ীর সহিত পুনরার দেখা হইবার পুবে এই সমস্যারই প্রতিবিধান 
করিতে হইবে। 

কিন্তু চা খাইতে নীচের তলায় নামিয়া আসিয়। সম্মুখে যে-দৃশ্ঠ দেখিলাম, 
তাহাতে তখনই আমার চিন্তার গতি ঘুরিয়া গেল। 

স্ স্নান সারিয়া একটি তরুণী আমারই জঙ্ঠ চা প্রস্তুত করিতেছে ইহা কি 
এক মিনিট পূর্বেও ভাবিতে পাবিরাছিলাদ? আমাকে সম্মুখে দেখিয়া! মেয়েটি 
জড়োসড়ো হইয়! বসিল। মাথায় একরাশ এলো চুল, হাতে কয়েক গাছি চুড়ি, 
পরণে বাসন্তী রুংয়ের একখানি শাড়ী-কিন্ত এই কয়েকটির সমন্বয়ে সে যেন 
তাহার চারিপাশে একটি লাবণ্যের পরিমগুল হৃষ্টি করিয়াছে । তৎক্ষণাৎ 
আমার নিকট মৃন্ময়ী তুচ্ছ হইরা গেল, এই তরুণীকে দেখিয়। প্রাণের ভিতরটা 
আমার আনন্দে আপ্লুত হইয়া! উঠিল। একপ্রকার অভিভূত উচ্ছ্বাসে সেখানে 
আর দ্লাড়াইতে ন! পারিয়া আম তাড়াতাড়ি মুখ ধুইতে চলিয়া গেলাম। 

কাল রাত্রে কাকীমা আপিয়াছেন, অনেক রাত্রে ফিরিয়া ঘরে ঢুকিয়াছি, 
ইহাদের আসার সংবাদ আর জানিতে পারি নাই। মুখ ধুইয়া আসিয়া 
বসিলাম। মা ও কাকীম! আসিয়া দাড়াইলেন। 

বলিলেন, রাতে খাওয়া দাওয়। বন্ধ কর্লি কেন রে? বাপকি সকলের 
চিরকাল বাচে ? 


৮৯ 


ঝড়ের সন্কেত 


মা আড়ালে দাড়াইয়া অশ্রু যুছিলেন। বলিলাম, কাল কখন্‌ এলে তোমরা, 
কাকীমা ? 

এসেছি কাল বিকেলে । দিদির কাছে শুনলুম তোর আজকাল চুলের টিকি 
দেখবার যো নেই । কি করিস সারাদিন ? 

আড় চোখে তরুণীটির দিকে চাহিয়া! লইলাম । মনে হইল, আমার কাজের 
হিসাব শুনিবার আগে প্রচ্ছন্ন একটি হাসির রেখা গোপনে তাহার অধরে 
মিলাইয়া গেল। ভয়ে আমার বুকের ভিতরট1 ধকৃ করিয়া! উঠিল । পিতৃ- 
শোকে আমি যে অধীর হইয়। আছি তাহা কি সে বিশ্বাস করে না, সেকি 
আমার গতিবিধির সংবাদ রাখে ? 

বলিলাম, কাকীমা, বাবা এমন অবস্থায় গেছেন যে, তার বিষয়পত্রের কোনে! 
হদ্দিশ পাইনে । কোথায় কি আছে, কোন্‌ দলিল কা"র কাছে, কিছুরই ঠিকান। 
নেই। সারাদিন আমাকে ছুটোছুটি করতে হয়। 

কাকীমা বলিলেন, কত খবরই তোর নামে পাই, কোনোটা আজপগুবী, 
কোনোটা অদ্ভুত । বিয়ে না করলে মন্দ কথা রটানোর লোকের অভাব নেই। 
একে চিন্তে পারিস? 

বলিলাম, কই না? 

ওমা, ভুলে গেলি? এর নাম আন্ত । ভালো নাম কি যেন বাপু মনেও 
থাকে না। ন” বছর বয়সে একবার এসেছিল আমার সঙ্গে । আমার মেজ- 
ভায়ের মেয়ে রে। 

হাসিয়া বলিলাম, কাকীমা, ফ্রক ছেড়ে শাড়ী পব্লেই মেয়েদের চেহারা 
বদলায় । 

কাকীমা বলিলেন, বাবা, কত কথা জানিপ তুই। 

আনু অতি কষ্টে হাসি চাপিয়া আমার হাতের কাছে এক পেয়ালা চ1 
রাখিয়া পলাইয়া গেল। বুঝিলাম, ফ্রকৃ ও শাড়ির তুলনা শুনিয়া সে তাহার 
উচ্ছল হাসি আচলে চাপিয়! সেখান হইতে সরিয়। পড়িল। 


৮ 


ঝড়ের সন্কেত 


কাকীম। এবার প্রশ্ন করিলেন, রাজেন, তুই নাকি বাবা সিনেমা কোম্পানী 
খুল্ছিস্‌? 

বলিলাম, ক্ষতি কি, কাকীমা ? 

ওমা ছি ছি, সেখানে যে শুনেছি স্বভাব চরিত্র ভালো থাকে না, 
বাবা । 

এবারে হাসিয়। বলিলাম, ভর নেই কাকীমা, যে-নিয়মে সিনেমা কোম্পানী 
মরন্ত হয়েছিল, সেই নিয়মেই তার মৃত্যু ঘটেছে । 

বাচলুম শুনে ।--কাকীম। বলিলেন, তোর মহন দেবচরিত্র ছেলে কি 
বাবা ওই সব নোংরা ঘাটতে যায় ?--পরে গলা নামাইয়া বলিলেন, কাচা 
পয়স1! হাতে থাকলে পাচজনে পাচ বুকম পশ্থামর্শ দেয়। 

বলিলাম, তোমরা থাকবে ত এখন কিছুদিন? মা ত* আমার স্ঙ্গে 
বিশেষ বাক্যালাপ করেন নাঁ। তিনি স্বামীশোকে অবীর | 

মা আডাল হইতে বাহির হইয়। আসিলেন। ভাসিমুখে বলিলেন, মুখপোড়া, 
কথা কইনে? খাবার আগলে ঝসে থাকি দিনরাত, থাকিস কোথায় তুই 
সারাদিন শুনি? আমি ত' এখনো মরিনি । 

বলিলাম, বাড়ীতে থাকবার জো নেই, বুঝলে কাকীমা? মা'র এই এক 
কথা, কবে বিয়ে করুব ! 

কাকীমা বলিলেন, আহা, তা বল্বে বৈকি বাব|। তোরা না হয় বাইরে 
ণাকিস, মন থাকে নান। দিকে, বাড়ীর গিন্নী পাচটা ছেলেপুলে বৌ-বি না 
খাকূলে কখনো থাকৃতে পারে? 

তার মানে, তুমিও বলতে চাও বিয়ের কথা । 

অলক্ষ্যে দেখিলাম, মা ও কাকীমার চারি চক্ষে মিলন ঘটিল। কাকীমা 
বলিলেন, সুই ত বরাবর বলে এসেছিস, ভালো মেয়ে পেলে বিয়ে করতে 
তোর আপত্তি নেই, এখন তবে কাটিয়ে দিস কেন? 

আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে, কাকীমা ? 


৮৩ 


বড়ের সন্কেত 


কাকীমা হাসিলেন এবং মা আমাকে মুখপোড়া বলিয়! চলিয়া! গেলেন। 
আমিও চ1 খাওয়! শেষ করিলাম । 

সকাল বেলা কোনও কালেই আমি বাড়ীতে থাকি না। রাত্রিটা কি 
ভাবে কাটাইব তাহারই বন্দোবস্ত করিবার জন্য সকাল বেলা টাঁক। পয়সা 
পকেটে লইয়া আমি সাধারণত বাহির হইয়া] পভি। ক্ুপুরে ফিরিয়া দিবানিদা 
এবং সন্ধ্যার সময় ফিটফাট হইয়া বাতির হইয়া যাওয়া । আগে ভাবিতাম 
আমার জীবনে বৈচিত্র্য আছে কিন্ু বৈচিত্রের ভিতর দিয়া চলিতে চলিতে 
এমন এক অবস্থায় আসিয়া পড়িয়াছি, যেখানে দ্ড়াইয়। জীবনের চেহারাটা 
বিবর্ণ বলিয়াই বোধ হয়। নৃতন নৃতন স্বাদ লইতে গিয়া জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া 
গিয়াছে, সেখানে আর কোনও চেতন! নাই । 

নিজের ঘরে আসিয়া ঢুকিতে গিয়া থমকিয়! দাড়াইলাম । আমার খর্বে 
কোথাও বিশৃঙ্খলা আছে তাহা আমি ন্গানিতাম না, অন্তে কেহ জানে ইহ 
বিশ্বাও করি না। কিন্তু আনু বলিয়া যে মেয়েটিকে কাকীমা! আমার নিকট 
পরিচিত করিলেন, এখন আসিয়া! দেখিলাম সেই তরুণীটি আমার ঘরে অনধিকাব 
প্রবেশ করিযম্বাছে। ব্রহ্দচারীর শয়ন-মন্দিরে সুন্ববী তরুণীর আবির্ভাব 
অপ্রীতিকর অবশ্যই নয়, কিন্তু ভিতরে ওই একটি মুতের জন্য মুখ বাড়াইয় 
যাহা চক্ষের নিমেষে দেখিলাম, তাহা এই সকাল বেলায় খুবই ভালো লাগিল 
তাহার হাতের ছোয়ায় আমার বিশৃঙ্খল সাজ আসবাবের সমস্ত চেহারাটাই 
একেবারে বদ্লাইয়! গিয়াছে । 

আমাকে দেখিয়া আন্গু একটু জড়োসড়ো হইল। এযাবৎ যে সকল নারীর 
সানিধ্লাভ করিবার সৌভাগ্য হইয়াছে, তাহারা আর যাহাই হউক, লজ্জায় 
সম্কচিত হয় নাই, বরং অভ্যর্থন। করিয়া কাছেই ডাকিয়া লইয়াছে। মৃন্য়ীকে 
প্রথম যখন দেখিলাম, সে ছিল যুদ্ধের ঘোড়া, তাহার ভয় ডর নাই, চক্ষু লজ্জা 
মানে না, অবাধে আমার সহিত একান্ত অসঙ্কোচে বাক্যালাপ করিয়াছে । 
কিন্তু ইহা কিরূপ? বাঙ্গালী গৃহস্থের সন্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে যে-মেয়েটি মানুষ 


৮৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


হইয়াছে, পৃথিবীর কোনো অভিজ্ঞতা, আনন্দ-বেদনীর সহিত যাহার আজিও 
কোনো পরিচয় ঘটে নাই, তেমন একটি নিষ্পাপ ও নিষ্কলক্ক কুমারীকে দেখিয়া 
আমি ষেন কেমন একটি নিগুঢ় আনন্দ অনুভব করিলাম । মুখে বলিলাম, যার 
বর এমন ক'রে গুছিয়ে দিলে, কই, সে মানুষটার সঙ্গে আলাপ ত করলে না? 

আন্ছ মুখে আচল চাপা দিল। 

বলিলাম, নামটি ত শুনলুম, ভালো নামটি ৩, কেউ বললে না? 

এবার সে কথ। কহিল, বলিল, আমার নাম মণিমালা । 

বলিলাম, জানো, এমন ক'রে ঘর গুছিয়ে দিলে পোকে তোমাকে তামাস৷ 
করতে পারে? 

মণিমালা বলিল, কাল সন্ধেবেল! আপনার ঘর গুছিয়ে দিয়েছি, আপনি 
লক্ষ্য করেননি । 

বলিলাম, বলো কি, এমন একটা ছুল সেবা সম্পূণণ অলক্ষ্যে হয়ে গেল? 
এখানে থাকবে ত' কিছুদিন? 

সে আর আমার মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। তাহার আপন ব্যক্তিত্ব 
কিছু নাই, ইহ। সে নীরবে থাকিয়াই আমাকে জানাইয়া দিল। আমি তাহার 
পড়াশুনার কথা জিজ্ঞাসা করিব ভাবিতে্ছি, কিন্ত আমার উপস্থিতিতে সে এতই 
'অধীর হইয়। উঠিয়াছিল যে, আর দাড়াইতে পানিল না, আমার পাশ কাটাইয়া 
একটি মাধবীলতার মতো আফিয়া বাকিয়া ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল। 


সাত 
মণিমাল! চলিয়। যাইবার পর আমিও প্রাত্যহিক অভ্যাসমতো বাহির হইব 
ভাবিতেছিলাম, এমন সময় কাকীম1 আলিয়! দরজার কাছে দ্রাড়াইলেন। 
বলিলেন, বাবা, ছু” একদিনের জন্যে আমি এসেছি, আমার কথার অবাধ্য 
হোয়ো না। 


৮৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বলিলাম, বলে! না কি বলছ, কাকীমা ? 

বলছি, আর তুমি অমত করতে পারবে না । এই মাঘেই এ কাজটি দেবে 
ফেল। চাই । 

বিয়ে? প্রশ্ন করিলাম 1--মেয়ে কই? 

তিনি বলিলেন, মেয়ের ভাবনা! কি? আন্তকে তবে আনলুম কি জন্যে? 

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, আন্ত) মানে তোমার মণিমাল1 ? 

কাকীমা হাসিমুখে বলিলেন, হ্যা রে ই), মণিমালা । 

তা কেমন করে হবে ? কী যে বলো তোমরা £ 

কেন রে, আন্ুকে পছন্দ হয় না? 

বলিলাম, ওদিক থেকে কোনো! কথ! ভাবিনি, কাকীমা । কিন্তু সে কেমন 
করে হবে? 

কাকীমা ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া চেয়ারে আসিয়া বসিলেন। তাহার বসার 
ভঙ্গী দেখিয়। মনে হইল, আপাতত তিনি উঠিবেন না, একটা কিছু নিষ্পত্তি তিনি 
করিতে চান্। আমিও কেমন যেন ভয় পাইয়া গেলাম । নিজের সকল রূপই 
কল্পনা করিতে পারিতাম, কিন্তু একটি নারীকে লইয়া বিবাহিত জীবন যাপন 
করিতেছি, আমার বহুমুখিনী কল্পনা এই পথ মাড়াইয়া কিছুতেই চলিতে পাবিত 
না। ভয় করিত এই কারণে যে, এমনি একটা নিদ্দিষ্ট জীবনে আমি যেন আমার 
মৃত্যুকে দ্েখিতাম, ষেন আমার সকল মানবতার বিকাশ ওই একটা বিশেষ 
অবস্থার পিগ্তরে আটকাইয়। স্তম্ভিত ও অবরুদ্ধ হইয়া গেছে, _ইহারই একট 
অস্পষ্ট ও ভয়াবহ চেহারা ভাবিয়া আমি মনে মনে কেমন যেন শিহরিয়া 
উঠিতাম। আমি বিবাহ করিব, প্রচলিত সংস্কার ও প্রথাকে অনুসরণ করিয়া 
এক অপরিচিতাকে ঘরে আনিয়া সকলের চোখের উপর বপিয়! স্বামী স্ত্রীর 
ভূমিকা অভিনয় করিব--এই কথাট1 ভাঁবিলেই আমার হাসি পাইত, নিজের 
এইরূপ অবস্থাটা আমি কোনোমতেই ভাবিতে পারিতাম না। 

কাকীমা বলিলেন, হতে পারে না কেন রে? 


৮৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তা! জানিনে কাকীমা, কিন্তু এ অসম্ভব । 

কাকীনা বলিলেন, বলতে নেই বাবা ওসব কথ! লোকে মন্দ বলবে। তুমি 
একটি মাত্র ছেলে, বিয়ে না করলে কি হয় বাবা? মানুকে ত দেখলি, ও কি 
তোর অযোগ্য ? 

চুপ করিয়া রহিলাম। কোন্‌ মেয়ে যোগা, অথবা কোন্‌ মেয়েটি অযোগ্য__ 
ইহা আমি খিচার করি নাই । উচ্ভাদের দিক হইতে স্বাতস্ত্রোর কথা, যোগ্যতার 
কথা কিছুই চিন্তা করি নাই। পুরুষের জীবন যজ্ঞে উহারা উপকরণ মাত্্র-_ 
উহ্তার। বিভিন্ন চেহারায় একই ধাত, একই বস্ত-_ইহাই ভাবিয়। আসিরাছি। 
পুরুষের মন ভুলাইবার ন্য উহাদের অনেকেই অধুনা াধুনিক বুলি আওডাইয়া 
কালোপষোগী হইয়৷ উঠিতেছে এইহট্রকুই মাত্র জানিয়া আপিরাছি, ইহার অধিক 
জানিবার অথবা ভাবিবার প্রয়োজন বোধ করি নাই। স্থতরাৎ মণিমাল। 
আমার যোগা হোক অথবা নাই হোক তাহাতে আমার কিছু যায় আসে ন|। 
আমার নারীকে প্রয়োজন এবং নারীকে করতলগত করিতে পারিলেই আমি 
আর কোনোদিকে ভ্রক্ষেপ করিতাঘ না । 

কাকীমা বলিলেন, আঙ্গুর গুণগান আমি করব না, আমি জানি বাবা তোর 
নিজের চেখ আছে । শুধু জিজ্দেস করি, ভুই কেমন মেয়ে চান? 

মুখ তুলিয়া বলিলাম, এত সহজে স্তনে নিতে চা কাকীমা? 

সহজ কথাই তো বাছ।|। ভদ্রঘরের সাধারণ একটি স্ুশ্। মেঘে পাওয়া কি 
যেমন-তেমন কথা? তোর স্থুখে-ছুঃখে, আপদে বিপদে তোকেই আগলে 
রাখবে-_-এর চেয়ে ভালো) এর চেয়ে বড আর তুই কি চাস? 

হাসিয়া! বলিলাম, কি চাই এখনি বলা ভারি কঠিন। 

আচ্ছা, সময় দিলুম, ভেবে বল্বি । লেখাপড়া আন্ত বেশ ভালই জানে । অবশ্ঠ 
এমন লেখাপড়া জানে নাষাতে দে তোকে রোজগার করে খাণ্ঘাতে পানবে। 

আমি আবার হাপসিলাম। কাকীমা ঘুখের একটা শব্দ কিয় তখনকার 
মতো উঠিয়া বাহির হইয়া গেলেন । আমি নিষ্কৃতি পাইয়া কাচিলাম। 


৮৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বাচিলাম বটে কিন্তু এ যেন একটা নৃতন সমস্যা দেখা দিল। বাড়ীর ভিতর 
ঢুকিয়া এইরূপে আমার উপর উৎপাত করিলে আমি বাঁচিব কেমন করিয়া ? 
চট করিনা আব কোনোদিকে ন] চাহিয়া খামোকা বিবাহ করিয়া ফেলিব, এত 
বড় অধঃপতন কি আমার সত্যই হইয়াছে? আমার ছুর্গতি আব কতদূরে 
পৌছিবে? অথচ কাকীমার কথাটাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার যো নাই। 
বিবাহ করিব না, এত বড় কারণ আমার জীবনে কি কিছু আছে? অথচ বিবাহ 
করিতে গেলে পাত্রীর যোগ্যতার পক্ষে যাহা কিছু প্রয়োজন তাহা মণিমালার 
একবপ সমন্তই রহিয়াছে । অপছন্দ করিয়া! এড়াইয়। যাইব তাহার কোনে। 
স্থবিধাই নাই। 

এই ভাবিয়াই আমার ভয় হইতে লাগিল যে, সমস্ত অবস্থাটা! মিলিয়া 
আমাকে যেন সংপথে আনিবার চেষ্টা করিতেছে । আমি যে অসৎ প্ররূতির 
মানুষ ইহা আমি যতট! জানিতে পারি নাই, অন্ত সকলে আমার আগেই যেন 
বেশি করিয়া জানিয়াছে। বস্ততঃ মহৎ স্বভাবের মানুষ আমি জীবনে খুব অল্পই 
দেখিয়াছি, কারণ, খবরের কাগজ পড়িয়া আর জন সাধারণের মুখে শুনিয়া 
যাহাদদের মহৎ ব্যক্তি বলিয়া জানিতাম, তাহাদের অনেকেই ষোল আনা মহৎ 
নহে ইহা ত নিত্যই সংবাদ পাইতেছি। সুতরাং একজন প্রথম শ্রেণীর ভালো 
লোক দেখিবার আগে অবধি নিজেকে মন্দ লোক বলিঘ্না মনে করিতে পারিব না। 

মণিমণালাকে লইয়া কাকীমা তিন চার দিন অবস্থান করিলেন এবং আমিও 
এড়াইয়া পলাইয়! বেড়াইতে লাগিলাম। অপরাধ কিছু করি নাই, কিন্তু 
ইহাদের প্রস্তাবের সঠিক জবাব দিতে না পারিয়া যেন অপরাধী সাজিয়াই 
আড়ালে অবডালে রহিলাম। বিবেক বলিয়া একটা পদার্থের অবশেষ হয়ত 
তখনও কিছু আমার মধ্যে ছিল, ভিতর হইতে সেই ছুঃশীল আমার কানে 
"কানে কহিল, মেয়েটিকে অপছন্দ করিবে এমন যুক্তি তোমার নাই, উহাকে 
অযোগ্য বলিয়া তাড়াইবার মতো! বড আত্মপরিচয় তোমারই বাকি আছে? 
কিছুই নাই তাহা জানি । সত্য কথা বলিতে কি, অমন একটি নিফলুষ কুমারীর 


৮৮ 


ঝড়ের লঙ্কেত 


নিকট মাথা তুলিয়া কথা বলিবার মতো নিঃসঙ্কোচ সরলতাও আমার 
নাই। উহাকে দেখলে শ্রদ্ধায় সম্মানে আমার চক্ষু নত হইয়া আসে--এমন 
£বলতাও মনে মনে অনুভব করিয়াছি । 

কিন্তু তবুও কথা! থাকিয়া যায়। উহাকে দেখিলে আমি আকর্ষণ অনুভব 
করি না, আমার রসকল্পনা বিন্দুমাত্রও জাগ্রত হয় না, মনে হয় উহার আমেজ 
হইতে পলাইতে পারিলেই নিষ্কৃতি বোধ করি । উহার পাশে মুন্ময়ীকে কল্পনা 
কবিলে মুন্য়ী কেমন যেন আমার নিকট বড় হইয়া উঠে। বিবাহের কথা এখানে 
বড় নয়, সম্তবও নয়, মুনয়ী বিবাহের পাত্রীও নয়কিন্তু তাহার আচরণে, 
তাহার মধুর সহৃদতায় আমি এমন একটি জীবনের বড় আদর্শের প্রাণক্ষেত্রের 
আন্বাদ পাই যে, তাহা শত মণিমালার মধ্যেও সম্ভব নয়। সুতরাং আমার 
বৃতমান সমস্যা এই দাড়াইল যে, বিবাহ করিতে আমি অনিচ্ছুক নহি, কিন্ত 
এমন কোন্‌ মেয়েকে পাইব যাহার জন্ত মুন্ময়ীর মতো! শাপীর সহিত অনায়াসে 
সম্পর্কচ্ছেদ করিতে পাবি? নুন্ময়ীর ভিতরে এমন এক বস্তর সন্ধান পাইয়াছি, 
আমার প্রাণের ভিতরে এমন একটা শিকড় গভীরের দিকে নামিয়া গেছে যে, 
তাহা উপড়াইয়া৷ ফেলিতে গেলে আমার জীবনের অস্তিত্বের মূলেই হয়ত টান 
পড়িবে । অথচ মুন্ময়ীকে যে বিবাহ করিয়! জ্রীবনসর্দিনী কপিতে পারিব এমন 
একটা অদ্ভুত কল্পনা উভয়ের দিক হইতেই সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ ইহার 
জন্য সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবন একেবারেরই ধ্বংস হইবে ; মুখ দেখাইতে 
না পারিয়া মুখ লুকাইবার স্থানও আমাদের জুটিবে না এবং যে সমাজকে 
না মানিয়া আমরা বিবাহ করিব, সেই সমাজেরই বিভিন্ন আস্তাকুড়ের ধারে 
আমাদের জীবন অতিবাহিত হইবে । আমি ইহাও জানি, মৃন্ময়ী বরং মৃত্যু 
বরণ করিবে কিন্তু এই অকল্যাণজনক বিবাহে নিজের সম্মতি দিয়া আমাকে সে 
বিপদে ফেলিবে ন1। 

অবশেষে স্পষ্ট কোনো কথা আমার নিকট হইতে না পাইয়া কাকীমা 
একদিন মণিমালাকে লইয়! প্রস্থান করিলেন । মণিমাল আমাকে কাহার যেন 


৮৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


অলক্ষ্য ইঙ্গিতে প্রণাম করিতে আসিল, আমি বাধা দ্রিলাম। এই প্রণামের 
অর্থ আমি বুঝিতে পারি। ব্যথায় মন টন টন করিয়া উঠিল, একটা মন্ত 
মূল্যবান বস্থ হারাইয়া ফেলিতেছি_-একট! অদ্ভুত বেদনাবোধের সঙ্গে এ কথাও 
মনে হইতে লাগিল। হয়ত ইহার জন্য আমাকে কাদিতে হইবে এমন 
সম্ভাবনাও রহিল কিন্তু বিদায় না দিয়া উপায় নাই । যাহা স্হজে আপিয়া 
উপস্থিত হয় তাহা ষত মূল্যবানই হোক তাহার প্রতি কেমন একা” অহেতুক 
অনাসক্তি;* যাহ! পাই নাই, পাওয়া কঠিন,-_মনট] তাশ্ারই পিছনে পিছনে 
নির্বোধের ন্যায় ছুটিয়া চলে । 

তাহাদের বিদায় দিয়া দরজার কাছেই ঈাড়াইয়া রুহিলাম | শীতের মধাড়ে 
মধুর বোদ্রের দীপ্তি, তাহারই দিকে চাহিয়া নিজের ভিতরে অনুভব, 
করিলাম, মনে হইল নৃতন একট। চেতন! আমার ভিতরে রিরি করিতেছে । 
পূর্ব জীবনের ব্যথা বেদন। অথবা রসবিলাসের হিসাব নিকাশ নয়, কিন্ত আগামী 
জীবন সম্বন্ধে একট। ভয়জডিত ওৎস্থৃক্য । সম্ভোগে আমি লিপ্র, প্রনত্তি-বিলাসে 
আমার আজন্ম লালস! কিন্তু স্তরে অন্তরে সাথী খুঁজিয়া পাইবার এমন একট: 
নিবিড় কামনা তকই আগে জানিতে পারি নাই । স্ত্রীলোককে দ্বণ করি, 
তাহার প্রমাণ এই যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এতটুকু প্রশ্রয় তাহাদের দ্রিই না. 
স্্ীলোককে শ্রদ্ধাও করি, তাহার প্রমাণ আমার জীবন-রঙ্ঈমঞ্চে শ্রীমতী মৃন্য়ী 
দাসীর অবতরণ; কিন্তু স্ীলোককে যে স্থখ-ছুঃখ ও ভালোমন্দের সাথ 
করিয়া ঘরে আনিব--ইহা একেবারে অভিনব চৈতন্য । মানুষের অন্তর্চেতনায 
অনেক অস্ফুট কামনাই গুপ্তভাবে অবস্থান করে শুনিয়াছিঃ অনুকূল অবকা* 
পাইলে তাহারা প্রকাশ পায়, আজ কাকীমা ও মণিমালা আমিয়। আমার সেই 
অস্পষ্ট চৈতন্তটাকে নানাভাবে খোচ। দিয়! জাগাইয়া গেল। 

চিন্তাক্ষেত্রে যখনই কোনো! বিপ্লব ঘটে তখন তাহা হইতে মুক্তি পাইবার 
জন্য আমি অসংষত জীবন যাপন করিয়া থাকি। মৃুন্ময়ীর সম্পর্কে নৃতন চিন্ত 
করিতে গিয়া! আমি উদ্‌ত্রাস্ত হইয়া উঠিলাম এবং এই সমস্যাটা অতিক্রম 


৪১০ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


করিবার জন্, যে যাহাই বলুক, আমি তিন চারদিন ধরিয়া নেশা করিয়া 
ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। মুন্ময়ীর সংস্পর্শে আসিগা কয়েকমাস অস্বাভাবিক 
ভদ্রজীবন যাপন করিয়াছি, বত্মান জীবনটাকে তাহারই প্রতিবাদ স্বরূপ ছাড় 
করাইতে পারিলে কিছু স্বন্তিবোধ করি, এই মনে করিয়া নিজের রাশ আল্গ! 
করিরা দিলাম এবং কলিকাতার আনাচে কানাচে, সিনেমার ই&,ভিয়োয়, রঙ্গ- 
মঞ্চের পর্দার আড়ালে যাহারা সহজলভ্য তাহাদেরই অতিরিক্ত মুল্যে ক্রয় 
করির়1 পরমানন্দে কয়েকটি দ্রিন কাটাইলাম। ঘে-বন্তার ভয়ে মুনীর সাহায্যে 
শক্ত বাঁধ বাধিয়! নিজেকে সংযত করিয়াছিলাম, সহসা এই কল্পনা-বিপ্রবের মধ্যে 
দাড়াইয়া! নিজের হাতেই সেই বাঁধ কাটিয়া সকল দিক প্লাবিত করিয়া দিলাম । 
স্বীলোকের পদতলে ভক্তহৃদয়ে দাসখৎ লিখিয়া দিতে রাজি আছি, কারণ 
তাহারা আমাদিগকে অমৃতের আনন্দ স্মরণ করার, কিন্ত যাহারা কোনোদিনই 
কাছা দিয়া কাপ পরে নাই তাহাদের চক্ষু শাসনে পুরুষের ব্যবহাপ্রিক জীবন 
নিয়ন্ত্রিত হইবে, পুরুষ হইয়। এত বড় দৈম্তের কথ। ভাবিতে পাবি না। মুণুয়ী 
বাগ করিলে ক্ষতি নাই, পৈতৃক সম্পত্তির শেষ অবশেমটকু থাকিলে শত 
মৃণ্য়ী পায়ের তলায় আপিয়া পন্ডিবে, তখন ভালোবাসার কুল কিনারা৪ পাইব 
না। আমি আমার উন্মন্ত ঘোডাকে দিকৃবিদিকে ছুটাইয়। বেডাইতে লাগিলাম। 

সেদিন অপরাহ্ছের দ্রিকে একটা নূতন শিকারের সন্ধানে বাহির হইয়া 
কলিকাতার দক্ষিণ দিকে চলিতে ছিলাম । একখান! আঘুনিক মডেলের 
ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া আঙ্জ তিন দিন যাবৎ ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। পেট্রলের 
খরচ সম্পূর্ণ আমি দিই এবং উপরস্ত দশটাক1 করিয়া গাড়ীর ড্রাইভার হাত- 
খরচ পায়। গত বুহস্পতিবার রাত্রে বাড়ী কফিরিবার অবস্থা আমার ছিল না, 
সেই কারণে টাক্িষ্ট্যাণ্ডে গাড়ীর ভিতর ঘুমাইয়া রাত কাটাইয়াছি। আমার 
ন্যায় ব্পেরোয়া-চরিত্র ট্যাক্সি ওয়ালা ইহার আগে নাকি আর দেখে নাই। 

দ্রুত চলিতে চলিতে গাড়ীর গতি এক সময়ে মন্থর হইল । নেশায় আমার 
দুই চোখ ছিল স্ভিমিত। চমক লাগিয়া চোখ খুলিয়া! দেখিলাম পাশেই বড় 


৯৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বাগানে স্বদেশী সভার এক বিরাট সাজসজ্জা; মাঝে মাঝে তাহার ভিতর 
হইতে গগনবিদারী বন্দে মাতরম্‌ ধ্বনি উঠিতেছে । পুলিশ ও জনতায় জটলা 
পাকাইয়। গাড়ী ঘোড়া পার হইবার উপায় রাখে নাই । চৌমাথার পথ বন্ধ 
হওয়ায় গাড়ী এক পাশে দ্াড়াইতে বাধ্য হইল, আমি রাগ করিয়া চেঁচাইয়। 
ড্রাইভারকে কি যেন বলিলাম, কিন্তু পাহারাওয়ালার হাত দেখিয়! সে কিছুতেই 
গাড়ী বাড়াইতে সাহন করিল না। ব্যক্তিগত আনন্দ, স্বার্থ ও সম্তোগের 
লালসায় যাহাধ! ঘুরিয়। বেড়ায়, আমি তাহাদেরই একজন, স্থৃতরাং মহৎ 
আদর্শের জন্য যাহার। সর্বপাধারণের সেবায় লাগিয়া লোকজন ডাকিয়! সভাসমিতি 
করে তাহাদের সম্বন্ধে অপরিসীম বিরক্তি বোধ করিব ইহাতে আর সংশয় কি? 
গাড়ী থামিয়া রহিল এবং আমি ছুই চোখ লাল করিয়া ক্রুদ্ধ পশুর ন্যাম বসিয়া 
বসিয়। নাসাগর্জন করিতে লাগিলাম | 

মৃন্ময়ীর কথাই ভাবিতেছিলাম। একজন বিশেষ স্ীলোকের কথা সকল 
সময়ে ভাবিব এমন বিশ্রী দুর্বলতা আমার নাই ; তবু, মুন্য়ীর কথা স্বতন্ত্র । 
তাহাকে আমি এখনও আমার থাবার মধ্যে পাই নাই, ইহা গ্রথম কারণ; 
আর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হইল যে, সে আমাকে অদ্ভুত উপারে সংযত 
করিতে জানে । ডাকাতের লু*ন হইতে আমরা আত্মরক্ষা করি, কেবলই 
লুন্ঠিত হইবার ভয় থাকে । কিন্তু তাহার কাছে নির্ভয়ে আত্মসমর্পণ করিলে 
আর সমস্যা থাকে না, ভাকাতের মনুষ্যত্ব বোধ জাগে। তেমনিই করিয়া! 
মৃন্ময়ী আমাকে ভূলাইয়াছে। জানি ইহা নারীর একট] অস্ত, কিন্তু এই অসমের 
কাছে পরাজয় মানিয়া ফেলি, লুণ্ঠন করিতে পারিনা । এই ছুর্বলতা কাটাইবার 
চেষ্টা করিয়াছি, আজিও পারিয়া উঠি নাই । 

বাহিরে মহা] কলরোল কেঠলাহল চলিতেছিল। বোধ করি সভা ভাডিয়া 
যাইতেছে । ইহার পরে জনআোত বাগানের ভিতর হইতে বাহির হইয়া 
পথের উপর আসিয়া পড়িবে, আমার গাড়ী আর চলিতে পারিবে না । স্থৃতরাৎ 
হর্ণ দিয়া চেঁচামেচি করিয়া অনেক কষ্টে পাহারাওয়ালার নিকট চলিবার অনুমতি 


৯২. 


ঝড়ের পক্কেত 


পাইলাম । কিন্তু পাইবামাত্রই বাঁধা পড়িল। কে এক ছোকরা রাস্তা পার 
হইবার সমদ্ন নহস1! গাড়ীর ভিতর আমাকে দেখিয়াই কাছে আসিয়াই বলিল, 
ভালো আছেন? এদিকে কোথায় যাবেন? 

তাহার দিকে চাহিলাম এবং বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, বিশেষ 
আপত্তিকর জায়গায় যাবো । কে তুমি? 

চিনতে পারলেন না? 

বলিলাম একটুও না। 

সে কহিল, ভূলে গেলেন? আমি যে সেই শ্যামাকান্ত, সেই নাম ভাড়ানো 
নীরেন। 

তাই নাকি । হ্যা) তাই বটে। আচ্ছা, এসো গাড়ীতে, তোমাকে 
এগিয়ে দ্রিতে পারবো । কতদূর যাবে? 

নীরেন কহিল, যাবো না কোথাও, দিদি ওই সভায় গেছেন, তার বক্তৃতা! 
আছে-_-আমি তারই অপেক্ষায় দাড়িয়ে আহি । 

হাঁসিয়া বলিলাম, তোমার এই ভক্তির বকৃশিস কি, নীরেন। 

নীরেন হার মানিল না, বলিল, দিদিব আদেশ পালন করার আনন্দই 
আমাদের বকৃশিস। তিনি জেনারেল, আমর! সৈন্য | 

বটে% একটি তরুণী লীডারের স্সেহছায়া তোমাদের মতন কতগুলি 
ভাই আছে বলো ত? 

নীরেন হাসিল, কিন্ত আর উত্তর দিল না। আমার চোখ মুখের চেহার। 
দেখিম্! সে কিছু সন্দেহ করিল কিনা বলিতে পারি না। কিন্তু আমি একট 
অন্বস্তি বোধ করিলাম। 

চলিয়। যাইতে উদ্যত হইতেই নীরেন বলিল, আপনি একটু দাড়ান দয়া 
ক'রে। দিদিকে যদি পৌছে দেন তবে বড় ভালে হয়, আজ তিন দিন 
সভাসমিতির কাজে তাকে অনেক হাটাহাটি করতে হয়েছে । 

'আমার যে অনেক কাজ হে। 


৯৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পাচ সাত মিনিটও অপেক্ষা! করতে পারবেন না? .এখনই বেরোবেন 
তিনি । 

একটু ভর পাইলান। মুন্মরী অনুরোধ করিয়াছিল, নেশা করিলে আর 
যেন তাহার সহিত সম্পর্ক না রাখি; সেই অন্গরোধ আমি মানি নাই। 
আড়ালে যাহাই হোক কিন্তু সে আসিয়া আমার এই বীভৎস মুতি চোখে 
দেখিবে ইহা বড়ই লজ্জার কথা। বলিলাম, এখন আমি যাই । তোমার 
দিদিকে বোলো তার সঙ্গে এক সময় আমি দেখা করবে । 

কোথায় দেখা করবেন ? তিনি ত আর সেখানে থাকেন না? 

কেন? 

সেখানে একট! বিশেষ অশান্তি ঘটে গেছে । 

বলিলাম, এখন তবে থাকেন কোথায় ? 

কোনো ঠিক নেই । আজ কদ্দিনই এখানে ওখানে-_-কাল ছিলেন আমার এক 
মাসিমার ওখানে | এ কদিন ওর ভারি কষ্ট যাচ্ছে । ল্লান নেই, খাওয়া নেই"*' 

নীরেনের গলাটা একটু কাপিল। আমি তাহার দিকে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া 
রহিলাম। যে-বেদনার প্রতিকার করিবার সৃযোগ নাই, সেই বেদনার 
ইতিহাস শুনিলে কোথায় যেন একটু ব্যথা বাজে । আশ্রয় ও অন্নের জন্য 
পথে পথে সে ঘুরিয়াছে, আমাকে সংবাদ দিয়! বিব্রত করে নাই, ইহাতে 
আমার অভিমানেও লাগিল। কিন্তু নীরেনের অল্প এই কয়েকটি কথায় 
অনুভব করিলাম, ইস্পাতের অদ্ভুত কাণিন্য আর দীপ্তি ওই তরুণীর স্বভাবে__ 
আমার ন্যায় দুর্বলের সাধ্যও নাই তাহার সেই এশ্বর্ষের পরিমাপ করে। 

চলিয়! যাইতে পারিলাম না, ফুটপাথের ধারে গাড়ী আনিয়া নীরেনকে 
পুনরায় প্রশ্ন করিলাম, ভাই, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেন করা হয়ত অশোভন 
হচ্ছে, কিন্তু বিশেষ অশান্তিটা কি, ভারি জানতে ইচ্ছে করে। 

নীরেন একটু থামিল, তারপর বলিল, দিদি আপনাকে একথা কোনোদিনই 
বলতেন না, কারণ এখানে তার আত্মসন্মীনের দায়িত্ব আছে। কিন্তু আমার 


৯৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পক্ষে বলাই বোধ হয় কতবব্য, কেন ন৷ দিদির ছুঃখকষ্ট একেবারে মাথা ছাপিয়ে 
উঠেছে। 

বলিলাম, ষদ্দি তোমরা ব্যথা! পাও তা'হলে বলো না, নীরেন। 

ব্যথা আমার নয়, দিদির । আমাকে তিনি তিরস্কার করবেন জানি, কিন্তু 
তারই মুখ চেয়ে আমি-_- 

নীরেনের চোখে জল আসিয়া পডিল। আমি চুপ করিয়া রহিলাম। সে 
গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল, দয়! ক'রে আপনি কারো অপরাধ নেবেন না, 
নাজেনবাবু। আপনাকে তারা কেউ চিনতে পারেনি-_ 

বিস্মিত হইয়া বলিলাম, কি ব্যাপার হে ? 

লজ্জিত নত মুখে শীরেন বালল, দিদির কাছে আপনার যাতায়াত নিয়েই 
কথাট। ওঠে ' 

তাহার মুখের দ্রিকে চাহিলাম, চাহির] প্রশ্ন কিঞ্শম, তাপপর £ 

তাদের সকলেরই একটা বিশু লন্দেহ ভয়-_ 

তাই নাকি? তারপর ?-_আচ্ছা থাক্‌, বুঝতে পেরেছি, নীরেন। 

এই বালকের চক্ষু হইতে সহসা নিজের মুখ কোথায় লুকাইব ভাবিতে- 
ছিলাম, এমন সময় বিদীর্ণ ক্ঠে জনতা বন্দে মাতরস্ত প্বনি তুলিল। নীরেন 
বলিল, ওই যে, তিনি আসছেন । 

বিমূঢ় হইয়! বসিয়া রহিলাম। নীরেন গিয়া ভীড় সরাইয় মুন্ময়ীকে লইয়া 
আমিল। অত লোকজনের ভিতরে দুইজনে কি কথা হইল বুঝিলাম ন|। 
মুন্ময়ী আসিয়া আমার গাড়ীতে উঠিয়া মুখ বাড়াইয়া বলিল, কাল এর বাড়ীতে 
গিয়ে আমার খবর নিয়ে! ভাই | 

আচ্ছা ।_ বলিয়া আমাকে একট! নমস্কার জানাইয়া নীরেন চলিয়া গেল 
আমিও আমার গাড়ী চালাইতে বলিলাম । 

আমার পরিম্গুলে একট! উগ্র মিরার গন্ধ ছিল বোধ করি তাহাই লক্ষ্য 
করিয়া মুন্ময়ী আমাকে কোনরূপ সম্ভাষণ না করিয়া আড়ষ্ট হইয়া গাড়ীর 


৯৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


একপাশে বসিয়া রহিল । গাড়ী দক্ষিণ দিকেই চলিতে লাগিল। আমি এক 
সময়ে হাসিয়া বলিলাম, দিদির জনপ্রিয়তা আজ দেখলুম স্বচক্ষে । লক্ষ লোক 
মিলে হাততালি দিয়ে গেল, কিন্তু হায় রে জনসাধারণ, তারা জানলো না যে, 
দিদি অন্ন আর আশ্রয়ের জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । কোন্‌ দিকে যাবে 
বলো, মুনয়ী? 

মৃন্মরী আমার দিকে চাহিল। মদ্দির স্তিমিত চক্ষে দেখিলাম, তাহার ছুই 
চক্ষু ভরিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতেছে । কাঁদিতে তাহাকে আগে দেখি 
নাই, অশ্রুতে তাহার চোখ মুখ ভারি সরস হইয়া উঠিল। সমবেদনা তাহার 
প্রতি হইতে লাগিল সন্দেহ নাই, কিন্তু একদ্দিকে খুশিতেও আমার মন 
টলটল করিতিছিল। খুব ইচ্ছা হইল-_আমার সাহায্য চাহিয়া সে আরও 
কাদুক। 

কিন্ত আচলে চোখ মুছিয়া সে কহিল, আপনার সঙ্গে যেতে পারবে না, 
আমাকে নামিয়ে দিন্‌। 

বটে, আর এ-কদিন তোমাকে খুজে খুঁজে যে আড়াইশো! টাকার পেক্রল' 
পুঁড়িয়েছি? তার দাম? 

আপনার এ কথার মানে কি? 

থতমত খাইয়া বলিলাম, অবিশ্তি মানে কিছু নেই, তবে কি জানো, অনেক- 
দ্রিন তোমার সঙ্গে দেখাশোনা হয় নি। 

তীব্রকণ্ে মুন্ময়ী কহিল, নেশা করে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে 
আসবেন? কী বলেছিলুম আপনাকে ? আপনি উপকার করতে পারেন না 
অথচ স্ত্রীলোকের সম্্রম নষ্ট করতে পাবেন? আমাকে এখানে নামিয়ে দিন্‌, 
রাঁজেনবাবু। 

বলিলাম, তোমার উপকার অবিশ্তি আমি করিনি, হয়ত করার সাধ্যও 
নেই। তবে তোমার সেই হাজারখানেক টাকা আমার কাছে গচ্ছিত 
আছে, আমার ইচ্ছে তাই দিয়ে আপাতত তোমার একটা বন্দোবস্ত-_ 


৯৬ 


বড়ের সঙ্কেত 


মূন্ময়ী বলিল, .সে টাক! আমার নয়, দেশের লোকের । তাদের জন্যেই ও 
টাকা খরচ হবে। ও টাকায় হাত দিয়ে নিজেকে আমি অপমান করতে 
পারবে না। 

হাসিয়া বলিলাম, টাকাট। অবিশ্টি সবই আমি খরচ করেছি । কারণ 
দেশবাসীর টাকার সম্বন্ধে সাধুতার পরিচয় দেবো এমন নাবালক আমি নই এবং 
দেশের টাক] মানেই অপব্যয়ের টাকা, এ কথা কে ন। জানে। 

মুন্ময়ী আমার দিকে চাহিয়া বলিল, টাকায় দরিদ্রের লোভ নেই, আছে 
বডলোকের। তাদের লোভকে সংঘত করবে কে বলুন? তাদের হাতে 
পুপিশ, তাদের হাতে স্মাজ, তাদেরই হাতে দেশ শাসনের ভার । ভয় নেই, 
আপনার উপর রাগ করবো না। আপনার অভ্যাস যদি হয় প্রব্ণনা, আমার 
অভ্যাপ ন্যায়নীতি মেনে চলা । 

বলিলাম, তুমি রাগ করছ কেন, মীন? 

রাগ!/ আপনার ওপর ?-_বনিয়া মুন্ময়ী হাসিল, পুনরায় বলিল, আপনি 
কি মনে কক্রন নিরাশ্যয় আর নিরম্ন হয়ে আপনার সাহায্য চাইব? 
আমার মধ্যে দয়াবতীকে দেখেছেন, দপিতাকে দেখেন নি। আমাকে নষ্ট 
করতে পারেন, মুখ বুজে আপনার মতন ধণবান আর বলবানের অনাচার সয়ে 
যাবো, কারণ কিছু স্রেহের সম্পর্ক আছে €েব কি,-করুন আমাকে লোক- 
লাঞ্ছিত, জানি বলদপীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার কোনো 
দরবারই এই দুর্ভাগা দেশে নেই। কিন্তু তবুও বলছি, আপনার ওপর বাগ 
আমার নেই । 

তাহার দাস্তিক উক্তি আমি আর সহ করিতে পারিলাম না। হাতখান। 
তাহার সজোরে চাপিয়। বলিলাম, কেন নেই? বলো, তোমার অহঙ্কার আমি 
সইবো ন]। 

হাদিতে গিয়াও তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িল। চলস্ত গাড়ীর দোলায় 
তাহার ক্ষুধার্ত পরিশ্রান্ত দেহ ছুলিতেছিল, তবুও সে শক্ত হইয়া বলিল, সত্যিই 


৯৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বল্ব, সৌজন্যের কোনে! রীতিই আপনার জানা নেই। আপনাকে মান 
করেছিলুম নেশ! ক'রে আমার সঙ্গে দেখা করবেন না। আমার সম্ভ্রম নষ্ট 
হবে। আপনি শোনেন নি। এ কথা বার বার জানিয়ে রাখি, আপনার 
পায়ের তলায় আমি চূর্ণ হতে পাবি, সর্বস্বান্ত হতে পারি, কিন্তু আপনার এই 
আচরণের সহচাবিণী হতে পারিনে । গাড়ী দাড় করান্‌, আমাকে নামিয়ে দিন্‌ 
দয়া ক'বে। না না না, আমাকে ছেড়ে দিনঃ পথের সমুদ্রে আমাকে তলিয়ে 
যেতে দিন, এই কুৎ্দিত জীবন আমি দইতে পারব না ।--বলিতে বলিতে 
সে কাদিয়া ফেলিল। - 

তাহার হাত ছাড়িয়া দিলাম । বলিলাম, আচ্ছা দেব নামিয়ে । চুপ করো, 
কেঁদোন। গাড়ীর মধ্যে । কোথায় যাবে তুমি? 

জানিনে, আমাকে নামিয়ে দিন্‌।বলিতে বলিতে সে উত্তেজিত হইয়া 
উঠিল । 

বহুদূরে আসিয়া পড়িয়াছি, দক্ষিণ কলিকাতা ছাড়াইয়া দক্ষিণ দিকে অনেক 
দূর আসিয়াছি। তবুও গাড়ী থামাইতে বলিয়া! মৃন্ময়ীকে নামাইয়া দিলাম। 
সত্যই সে মেই প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় কূলকিনারাহীন পথে নামিয়! স্তব্ধ হইয়া 
ঈাড়াইল, এবং দীডা ইয়া দাঁড়াইয়! সেই হতভাগিনী দেশসেবিকা ফুলিয়! ফুলিয়া 
কাদিতে লাগিল। আমার গাড়ী আবার উদ্ভ্রান্ত হইয় চলিতে সুরু করিল। 
তখন জনহীন পথের আশপাশে কোথাও কোথাও সন্ধ্যার আলে! জলিয়াছে। 

মৃন্মমী জানে না পুরুষের মন। তাহাকে ছাড়িতে গিয়াও যে আমার 
হৃদয় নিরুপায় আকুল হইয়া উঠিল তাহা সে দেখিতে পাইল না। সেপ্দিন এক 
অদ্ভুত নেশা করিয়া ছিলাম, তাহারই উগ্র মাদকতার ঝোকে আপন গভীর 
অস্তঃস্থল অবধি তলাইয়! অনগভব করিলাম, মৃন্বায়ীর জন্য সেখানে একটি শ্রদ্ধা 
ও সম্মানের আসন পাতিয়া রাখিয়াছি। বাহিরে তাহাকে অসম্মান করিলাম, 
তাহার অন্গরোধের মূল্য দিলাম না, তাহার নিরাপদ আশ্রয়কে নষ্ট করিলাম-_ 
কিন্তু ভিতরে ভিভবে আমার নারীম্থলভ একটি হৃদয় নিরন্তর তাহারই কাছে 


৯১৮ 


বাড়ের সঙ্কেত 


আশ্রয় ভিক্ষা করিয়া ফিরিতেছিল। আমি যেগত কয়েকদিন হইতে তাহাকে 
না দেখিয়া আপন মনেই জঞ্জরিত হইয়া উঠিয়াছি ইহাকি সে চোখে দেখিতে 
পাইল না? 

কয়েকটি মুহুর্ত মাত্র । মনে হইতে লাগিল আমার হৃদয়, আমার প্রাণ, 
আনার সকল ধমণধন্ঢ আর ইহকাল পরকাল ওই নিরাশ্রয় পথচারিণী ক্ষুধাতৃষ্ণা- 
কাতর মেয়েটর কাছে ফেলিয়া! আসিয়াছি, বাকী জীবন কাটাইবার মতো 
কোনো! সম্বল আমার নাই৮_কে যেন আমার শবদেহকে বিপরীত পথে টানিয়। 
লইয়া যাইতেছে । 

মা চীৎকার করিয়া উঠিলাম, এই উল্লুক' গাড়ী রোখো। 

ডি গাড়ী থামাইল। তাহাকে পুনরায় গাড়ী খুরাইয়। যেখানে 
মন্সয়ীকে ছাড়িয়াছি সেইখানে লইয়া যাইতে বলিলাম সে গাডী ঘুরাইয়া 
পুননার দৌন্ডিল, আমি তাহাকে বকশিস কবুল করিলান। 

অনেকদূর আছিয়। পড়িয়াছিলাম । পথের ছুই ধানে খুজিতে খুঙ্জিতে 
সবশেষে এক সময়ে মুন্ময়ীকে দেখিতে পাইয়। গাড়ী থামাইলাম। গাড়ী হইতে 
ননিরা তাড়াতাড়ি তিনথান। দশটাকার নোট বাহির করিয়। ড্রাইভারের হাতে 
দিলাম । সেগাড়ী লইয়। চলিবা গেল। 

বড় রাস্তার ছুই ধারে ফাক! গ্রামের পথ । শীতের সন্ধায় পথে জনমানব 
লাই । পথের ধার দিয়া মুন্মরী আপন মনে চলিতেছিল, কাছে আসিয়া 
ডাকিলাম মীন ? 

সে ফিরিয়া চাহিল। আমি গিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিলাম, ফিরে 
এলুম তোমার জন্যে । এবার থেকে আর তোমার অবাধ্য হব না। 

ুন্ময়ী ধীরে ধীরে বলিল, সমস্ত দিন স:হদ থাকে, অন্ধকার হ'লে বড় একলা 
আনে হয়। তখন ভয় করে। 

কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? 

কোথায় যাবো তাই ভাবছিলুম । 


৯৯ 


ধরা গলায় বলিলাম, যাবে আমার সঙ্গে? 

সে একবার আমার মুখের দিকে চাহিল, তারপর আমার হাতখানার উপর 
মাথ। হেলাইয়। জড়িত, ভগ্ন ও অঙ্পষ্টন্ববে কহিল, ভয় করে। 

বলিলাম, তোমার মাঁয়ের ছুর্গতি হয়েছিল আমার বাবার জন্তে, আমার 
হাতে ভোনার দুর্গতি হতে দেবো না। চলো আঙ্গ আমার সঙ্গে । এ কথাটা 
আজ তোমার কাছে প্রমাণ করতেই হবে, আমাকে যে বিশ্বাস করে আমি 
তার ক্ষতি করিনে; নি:ম্বার্থ স্নেহের কাছে আমি দানখত লিখে দিতে পারি 
এও তোমাকে জানিয়ে দিতে হবে । 

জীবনে যাহা কখনও ঘটে নাই, স্ীলোকের নিকট হৃদয়াবেগ প্রকাশ করিয়া 
ফেলিলাম , কেবল তাহাই নয়, নারীর সহিত কথা বলিতে বলিতে এই প্রথম 
আমার চোখ ভরিয়া জল ছাপাইয়া উঠিল। ইহা আমার উন্নতি অথব; 
অবনতি বুঝিতে পারিলাম না। 


আট 


ধ্মতলার কাছাকাছি একটা বড় বোডিংয়ে আলিয়া! উঠিতে রাত্রি আটটা। 
বাজিয়া গেল। তাহার পাশী হ্বত্বাপিকারী আমাদের দেখিয়া কোনরূপ 
অন্থবিধাজনক প্রশ্ন করিল না, বরং সাদরে অভ্যর্থনা করিয়া একটি স্থনজ্জিত 
ঘরে আম।দের লইয়া গেল। গৃহস্থ ঘরের ন্যায় কোথাও সাঁজ-সরঞ্জামের ক্রি 
নাই । পাশেই বাথরুম। দৈনিক খরচ জনপিছু তিন টাকা। 

উতকন্তিত হইয়া মুন্ময়ী বলিল, এ কি করলেন? 

বলিলাম, কোনে ভয় নেই, মীন । আমি ত' রয়েছি । 

আপনি থাকলে যে আরো বিপদ ! ওরা বলগবে কি? 


৬১০০ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


হাসিয়া বলিলাম, ওরা বলবে ষে শ্রীমতী মুন্ময়ী দেবী যাদুমন্ত্র জানেন। 
তার শাসনে বনের বাঘ ধ্যানী বুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। যাও, মুখ হাত ধুয়ে, 
এসো দু'জনে বসে এক সঙ্গে খাবো । 

আপনার মামনে আমি খেতে পারবো ন1। 

তাহার দিকে চাহিলাম। নে স্হস! বলিল, ওরে বাবা, আবার সেই 
চোখ | এই বলিয়! ছুটিয়। সে বাথরুমে গিঘ্বা টকিল। আমি খাবাদের অর্ডার 
দিলাম। 

বাহিরে মাঘের শীতের রাত্রি। কলিকাত। শহরের অবিরাম জনকোলাহল 
এবং যানবাহনের অশ্রান্ত জটলার ঠিক মধাস্থল বলিয়াই আনম!দের আজিকার 
এই বাত্রি এত নিঞ্জন ৪ নিঃসঙ্গ । নিকটে দুরে কোথাও আম্মীর-বনু, পরিচিত 
এমন কেহ নাই যে, আমাদের সম্গন্ধে কৌতহল প্রকাশ করে। অতি নিশ্চিত, 
নিভৃত এবং নিরুদ্ধেগ মানাদের এই নৈশ জীবন৮_নদাজ এন লোক-লজ্জা 
বলিয়া কোনে] পদার্থ আমাদের চৌহাদ্দির মধ্যে নাই । 

মন্মরী আমিব আহার পছন্দ করিল না, উপবাদে কাতর ছিল বলির! শল্প 
স্বল্প থাবার লইল। মামি জাতিতে হিন্দু বটে, কিন্তু আহার-বিহারে মোগল- 
সভ্যতার অনুগামী, তরাৎ পাশী ম্বহাধিকারী মহাশয় আমাকে খা ওিয়াইয়। 
পরিতোষ লাভ করিলেন । আমি নেশা করিয়াছি তাহা তাহার চক্ষে ধর। 
পড়িল, এবং আমর! কোন্‌ শ্রেণীর জীব তাহা স্টাভার ঈষৎ কটাক্ষে জানিতে 
পারিলাম। আমার পোষাক পরিচ্ছদ, ভঙ্গী, খোসখেয়াল দেখিয়। আমার 
প্রতি গাতিরের মাত্রা বাড়ির! গেল। তিনি যাইবার সময়ে নিজের ভাতে 
টানিয়া আমাদের ঘরের দরজ| বদ্ধ করিয়া গেলেন। মুগ্সঘী অপ্রস্থত হইয়া 
মামার দিকে চাহিল । আমি নত মস্তকে বলিয়া আমার হিংস্র দংষ্রাব সাহায্যে 
একটি সুনিদ্ধ মোরগশিশুর পঞ্চবাস্থি চর্বন করিতে লাগিলাম। 

মুন্ময়ী এক সময়ে কহিল, আপনার কাছে অনেক কিছু শিখলুন । 

প্রশ্ন করিলাম, যথা? 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পয়সা দিলে কলকাতায় সবই পাওয়া যায় ; তৈরি রান্না আর তৈরি বিছানা 
পর্যস্ত। এ আমি জানতুম না। 

বলিলাম, এত” সামান্য বললে । আরো অনেক কিছু । কিন্ত মীন্তুঃ। এই 
কথা ভেবে আমি আশ্চয হচ্ছি যে, তুমি যাদের 'গ্রতিপালন করলে, তাদের 
কাছে তোমার ঠাঁই হোল না? এর সত্যি কারণ কি? 

মূন্ময়ী আহার শেষ করিয়া উঠিল। হাসিমুখে বলিল, নীরেন বুঝি বলেছে 
আপনাকে ? 

না বললেও ত' একদিন এ খবর পেতৃম । 

তার! ছেলেমানুষ, বুঝতে পারেনি, আপনি তাদের ক্ষমা করুন৷ 

তোমার ধম দাদা আর দ্রিদিরাঁও কি ছেলেমানুুষ ? 

মুন্ময়ী বলিল, অনেকদিনের কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে, তাদের অপরাধ 
নেই। আপনার খবর তারা পেয়েছিল, তাই আপনাকে তারা পছন্দ করেনি ! 

বলিলাম, তুমি ত' তাদের আপন ? 

মৃন্ময়ী বলিল, দেশের কাজ তাদের সকলের আপন । আমি তাদের অন্দু 
মাত্র, আর কিছু না। জানি আমাকে ছেড়ে তারা ছুঃখ পাবে, হয়ত দারিডোর 
ছুঃখও পাবে, কিন্ত তবু আপনার সঙ্গে আমার আলাপ বরদাস্ত করবে না। 

আমি ত' তাদের কোনো ক্ষতি করিনি । 

না।-_মৃন্ময়ী বলিল, বরং উপকার করেছেন টাঁক1 দিয়ে । তবু এই তাদের 
ধারণা । আমি কোনো বাইরের পুরুষের সাহচর্ধে এসেছি, অথবা ঘনিষ্ঠত! 
হয়েছে, এ তারা বরদাস্ত করবে না। 

একে তার] অন্তায় বলে? 

একে তারা ত্বণা করে। তাদের জীরন, তাদের চিন্তা, কল্পনা, ন্বপ্র, 
তাদের ধর্মীধর্ম দেশসেবা নিয়ে । তারা ভালোবাসা বোঝে না, স্মেহ, বন্ধুত্, 
প্রেম--এ সমস্তই তাদের কাছে অলস চিত্রবিলাস। তারা মনে করেছে, 
আমি এদের ফাদে জড়িয়ে পড়েছি, তাঁরা আমাকে উচ্ছেদ ক'রে দিয়েছে । 


১০২ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তুমি কিআর কোনদিন সেখানে য'বে না? 

মৃন্ময়ী বলিল, যদি যাই, তবে তাব্রা গোয়েন্দা মনে করবে। 

বলিলাম, তাহলে আমি তোমার চরম ক্ষতি করেছি বলো? 

মুন্সয়ী বলিল, ক্ষতি আমি মনে করিনি। নিজেদের ভূল একদিন তাঁরা 
বুঝতে পারবে, এই আশা ক'রে রইলুম। তারা বুঝবে পদস্থলন হওয়াটাই 
চরিব্রবিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়, তারা বুঝবে স্মলিতপদ মানুষও আপন 
মনুয়াত্বের প্রভাবে শর্বজনবরেণ্য দেশনেতা হ'তে পারেন,--ভার শ্রমাণ 
বাংলাদেশেও আছে। জানি আমাকে ওরা আজ তাড়িয়ে দিলে, 
জানি দুরব থেকে চিরদিনই ওদের সেবা] করব, কিন্তু ওদের একথ। 
কোনদিনই মানবো না যে, ভালোবাদা বা বন্ধুত্ব ম্বভাবের অবনতি ঘটায়, 
কিন্বা-_ 

কিম্বা কি, বলো? 

আপনার প্রতি ওরা প্রসন্ন নয় । 

কিন্ত তুমি? প্রশ্ন করিলাম । 

একটু ভয়ে ভয়ে-_বলিয়! মুন্মরী হাদিয়া! উঠিল । 

আহার শেষ করিয়া উঠিঘা বলিলাম, মুন্নয়ী, ঝ'লে রাখলুম, আমি ওদের 
বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবো। 

দেখিতে দেখিতে মুন্ময়ীর চোখ মুখ স্তব্ধ বিবর্ণ হইয়া গেল। মনে হইল 
আশঙ্কা আর উত্তেজনায় তাহার যেন এখনই দম বন্ধ হইয়া আদিবে। আমি 
খাটের উপর বপিলাম, সে সহসা আসিয়া আমার পায়ের উপর কাদিয়া কহিল, 
কী বন্ছেন আপনি? আপনি কি সর্বনাশ করতে চান্‌ আমার ভাই বোনদের ? 
জানেন আপনার প্রতিশোধের মানে কি? 

বলিলাম, জানি, সকলের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তুর | 

বন্ধ ঘরের ভিতরে এই আত্মত্যাগিনী তরুণী আমার দুই পা! জড়াইয়া 
আকুল কণ্ঠে কহিল, আপনার বন্ধুতা আর শক্রতা ছুইই ভয়ঙ্কর জানি, তবু 


১০৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আমার সর্বন্ব নিন, আমাকে নিয়ে যা খুশি করুন, প্রতিবাদ করবো না--কিন্তু 
'আমার ভাইদের, আমার বোনেদের আপনি বাচান্‌ । 

কান্নায় ও চোখের জলে তাহার সর্শরীর ফুলিয়া ফুলিয়া কাপিতেছিল। 

বাহিরে রাত্রি এগারোটা বাজিল। 

আমি তাহার হাত ধরিয়া তুলিলাম। বলিলাম, মীন্গ, আমাকে বোঝাতে 
পারো তোমার এই চবরিত্রতত্ব? তোমার তকিছু নেই, তোমার দুর্দিনে ত 
কেউ সাহাযা করবে না, তবে কেন এই মিনতি? বাংলা দেশের দেয়ে কি 
কেবল কাদবে, মাথা উচু ক'রে দাড়াবে না? একথা কি বলতে পারো না 
যে, তুমি কোনো অপরাধ করোনি, আর কল্পিত অপরাধের বোঝা তোমার 
মাথায় যারা চাপাতে চায় তাদের বুকের রক্ত নিয়ে তুমি ছুই হাত রাঙাতে 
পারো ? 

তআচলে মুন্সয়ী চোখ মুছিল। বলিল, না, আগে হয়ত পারতুম, কিন্তু 
এখন-- 

এখন তোমার কী পরিবত'ন ঘটেছে শুনি? 

নতমন্তকে মে কহিল, জানিনে । কিন্ত মাথা উচু ক'রে দান্ডাবান সাধ্য 
আর আমার নেই। 

কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম । পরে বলিলাম, আজকেন্পু রাতটা না 
হয় এখানে কাটলো, কিন্ত আবার কাল থেকে তৃমি কোথায় থাকবে ? 

এবারে মৃন্ময়ী মৃহ হাদিল। বলিল, কালকের কথা কালই ভাঁববো, 
আজকের রাতটা ত” ভালোয় ভালোয় কাটুক । 

বলিলাম, মীন, বসো এইখানে । অমি কি ভাবছি জানো? ভাবছি 
আজকের বাত স্বধু কেন, তোমার সমস্ত জীবনের প্রত্যেক দিনরাতিই 'ভালোয় 
কাটুক। 

হাসিমুখে মুন্মমী পাশে বসিয়া কহিল, বিশ্বাস হয় না। 

কি বিশ্বাস হয় না বলো? 


১০৪ 


আপনার কথা । 

কেন? 

আপনিই ত" বলেছেন, আপনার মুখের সঙ্গে মনের মিল নেই ? 

গলার আওয়াছেও কি বুঝতে পারো না? 

মন্ময়ী বলিল, আপনি সেদিন বলছিলেন, নেশা করলে মনের মধো একট। 
ক্ুত্রিঘ আর ক্ষণস্থায়ী আবেগ তৈরী হয়, কারণ মাদকবস্থতে কেন্দ্রীয় স্সামুতস্তে 
উত্তেজনা জমতে থাকে, সে কাবণে মুখে ভেসে হঠে প্রলাপতাএসব ত 
[পনাবই কথা । 

বলিলাম, তাহলে আমার কথায় তুছি বিগাস করে না? 

বিশ্বাস করবার মতন কথা হ আপনাল নয় । 

কিসে নুঝলে ? 

সে কহিল, আপনি আমার কলানকামনা করলেন অথচ ভেবে দেখলেন 
না রাত্রি আমার ভালোয ভালোয় কাটবে কেমন কানে! 

বলিলাম, আমি তভোনান জন্যে কি কল্তে পাবি বলো, মী । 

মন্ারী চাঞ্চল্য প্রকাশ করিরা কিল, ভি ছি, আমি অম্পষ্টভাবে কোনো 
প্রস্তাব মাপনার কাছে করছিনে, কোনে! মগ আর ভীনতা যদি প্রকাশ পাস 
তবে আমার মৃত্যুই ভালো, কিন্ু আমি দেখতে চাই আপনা কল্পনা । 

তাহার হ্কাতখান। শন্ত করিঘা পবিলান, বলিলাম, বলো মুন্য়ী, আমার 
কাছে তুমি কিচাণ্ড? 

সে কহিল, কিছ্ডু না। 

যেষ! চেঘেছে আমি দিদেছি | €তামার কিছু নেই, ভাই কি তিমি কিছু 
চাওনা? 

কম্পিত কণ্ঠে মুন্বাধী বল্লিল, সহজে যদি কিছু পাই দেবো, চেয়ে 
নেবে! না। 

বলিলাম, কী পেলে তুমি খুশি হ5 ? 


৯০৫ 


বড়ের সঙ্কেত 


আমি পেলে খুশি হই এমন কিছু আপনার আছে কিনা! তা ভেবে 
দেখেছেন ? 

তাহার হাত ছাড়িয়া দিলাম । বলিলাম, আমার কি আছে আর কি 
নেই জানিনে, কিন্ত যদি তোমায় কিছু দেবার মতন ষোগ্যতা আমার থাকতো, 
আমি সত্যিই খুশি হতুম, মুন্ময়ী। 

মৃন্ময়ী কহিল, আমি কিছু পাবার জন্যে উৎস্থক--একথা কি কোনোদিন 
প্রকাশ করেছি? আপনার যাওয/ আসার পথ আমি খুলে রেখেছি, দাবি 
কিছু জানাইনি। কিন্তু তবু নিজেকে আমি দ্বণা করি। 

সঘ্ণ।। কেন? 

নিজের অক্ষমতার জন্ঠে। ছুটো। কাজ আমি পারিনি, আপনাকে ত্যাগ 
করতে আর আপনার নেশার অভ্যাস ছাড়াতে । 

নেশার চেয়েও ত মন্দ অভ্যাস আমার আছে । 

মূন্য়ী আমার মুখের দিকে চাহিল, বলিল, জানি । এও জানি, আপনি 
যাকিছু মন্দকাজ করেন তার সঙ্গে আপনার জদয্ের ফোগ নেই । জানি 
কিছুতেই আপনি তলিয়ে যাবেন না। 

বলিলাম, কি ক'রে জানলে? 

মুন্মরী হাসিয়া কহিল, মেয়েমানষের চোখ ! 

কিন্ত এতই যদি জানো, এটাও জানতে পারোনি কেন ঘে, কি আমি 
চাই? 

আপনার সমস্ত চাঁওয়াই অস্পষ্ট, তার কারণ আপনার নিজের সম্বন্ধে কিছু 
জানা নেই। 

মানে? 

মুন্নী আমার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, আচ্ছা, আজ আমি ছাড়া 
এখানে আর কেউ নেই ; এই বাত্রিকাল, নিজের মনের নব গেরো খুলে দিন, 
কল্পনাকে দ্দিন ভাসিয়ে, তারপর আমার দিকে চেয়ে বলুন, কী আপনি চান। 


১০৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তাহার প্রতি চাহিলাম। ঘরের ভিতর দপ দপ করিয়া আলো জলিতে- 
ছিল, ভিতরটা ষেন সকল দিক হইতেই হাসিতেছে। রাত্রি গভীর সন্দেঠ 
নাই, বাহিরে জন-কল্লোল আর কানে আদিতেছে না, চারিদিকের পরিম গুল 
কেমন যেন নিবিড় হইয়া উঠিয়াছে । মনের গ্রন্থি কখনও খুলি নাই, কারণ 
মন অতি জটিল। কখনও কোনো প্রার্থনা করি নাই, ঈশ্বরের দিকে কুলিয়াও 
চাহি নাই, মানতযের দরবারে কোনে আবেদন আছে, ইহাও আমার কল্পনাতীত 

এবং এমনি করিয়াই চিরদিন কাটিয়াছে, এমনি করিয়াই প্রবৃত্তির তাডনায় 

অন্ধের ন্যায় আজীবন ছুটিয়াছি, পিছন দিকে লক্ষ্য করি নাই । কি চাহি তাহা 
জানি না, কি পাইব তাহাও আমার নিকট অজ্ঞাত। মুগ্কাধীব প্রশ্নের উত্তর 
আমি দিতে পারিলাম না। কেবল আড হইয়া শুইয়া পড়িলাম। 

দে উঠিয়া গেল, অন্য খাটে গা বঙসিল। তারপর কতিল, কই, বলতে 
বুঝি সাহস হোলো না! আপনার ? 

বলিলাম, ক্ষম1 করে?, বলতে কিছু পারলুষ না। 

সে হাস্মুখে বলিল, এই কথাই আমি ভীবছিলুম। জানি, চাইবার লাহস 
আপনার নেই । এমন মাঘ থাকে ধারা চিরকাল গৌজ-গৌক করে, অহেতুক 
অসস্তোষে তারা পুডে পুড়ে খাক্‌ হয়ত আপনিও তাই । আচ্ছা, 
বল্‌্তে কিছু হবে না, বুঝে নিতে পারবো । কিন্ধু নই, আমার কথা! ত কিছু 
বললেন না? 

বলিলাম, এতকাল নিজের কথাই ভেবেছি, অন্বের ভালোমন্দ নিয়ে কখনই 
আলোচন! করিনি । 


ুন্ময়ী বলিল, যে-মানষ আপনার জন্যে ভাবে তার হিতাহিত ভাবাও কি 


ও) 


আপনি কত'বা মনে করেন না? 
অর্থাৎ তুমি, কিন্ত তুমি ত' আমার কোনো সাহ্ায্যই চাও ন।? 
সাহায্য ত' চাইনি, স্তধু বলছি আমার হিতাহিত আপনার হাতে । 
বলিলাম, তার মানে? 


১০৭ 


পক 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মুন্সী বলিল, তার মানে আপনি যদি আজ থেকে পুরোদস্তর একটি “গুড, 
” বয়? হয়ে ওঠেন, তাহলেই আমি উপকৃত হবেো। 

গুড, বয় তুমি কা'কে বলে? 

যে নেশা করে না, উড়নচুড়ে নয়, যে বাধ্যবাধকতা মানে, বেহিসেবী নয়, 
যার কতব্যবোধ আর দয়াধম্ আছে । 

এইবার আমি হাসিলাম। বলিলাম, আগের কথাগুলো বুঝতে পারি, 
কিন্ত শেষের দিকে ওই যে কতরবব্যবোধ আর দরাধম--ওর মানে কি? 

জানি নে।__বপিয়! মৃন্ময়ী সহলা লেপ মুড়ি দিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল । 

কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়৷ রহিলাম। তারপর উঠিয়া বসিয়া বলিলাম, নেশা 
আমার ছুটে গেছে, এখন আমার কথা বিশ্বান করতে পারে।। আজ যদি বল 
তোমাকে আমি ভালোবাসি, তাহলে নিজের কানেই কথাটা ভান্যকব োনার, 
সুতরাং সে-কখা বলব না। এমন কথাটা যদি বলি তোমাকে ছেডে খাক। 
আমার পক্ষে কঠিন, তাহলেও তুমি বিদ্রপ করতে পারে কারণ পথে-পথেই 
ভুমি বালা বেখেছ__তুমি আমার থেকে কিছুই নিতে চাও না। তবু আজ 
এই বাত্রিকালে আমার বুকের ভিতরকার ঈশ্বরের দিকে চে়ে বলছি, আমার 
কাছে কিছুই যে চায় না সে আমার বড় প্রিয়; ইচ্ছে করে তারই জন্যে আমি 
লবন্বাস্ত হই । আচ্ছা যুন্ময়ী, আমাকে ত্যাগ করতে পারোনি ব'লে নিজেকে 
তুমি ঘ্বণা করো? 

লেপের ভিতর হইতে মুন্সয়ী বলিল, হ্যা । 

কেন? আমি কি এতই অমানুষ? 

মুখের উপর হইতে লেপ সরাইয়া মুন্ময়ী কহিল, সম্পূর্ণ অমানুষ হ'লে ছেড়ে 
যাওয়া সহজ হোতো। কিস্তুতা আমি পারিনি। আপনার জীবনের দিকে 
চাইলে আমার কান্না পায়, অনেক ভালো জিনিস আপনার মধ্যে চাপা রইল, 
অনেক বড় আদর্শের কথা আপনার মধ্যে তলিয়ে গেল; দেখলুম, আর 
ভাবলুম আপনার সম্ভাবনা ছিল অনেক | বুদ্ধি আর বিক্রম দিয়ে জীবনটাকে 


৯০৮ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আপনি শাসন করতে গেলেন, সেই জন্তে দানবীয় রূুপটাই দেখা গেল; ফি 
এর সঙ্গে থাকতে! জ্ঞানের যোগ, তবে আপনার আর ভাবনা কি ছিল?. 
সম্ভোগের আনন্দে নাচলেন এতকাল, কিন্তু চেয়ে দেখেননি আপনার পায়ের 
চাপে কত প্রাণ ঘুঁভিয়ে গেল। আপনাকে ত্যাগ করতে পারিনি, সেইজন্তে 
নিজের ওপর স্বণা এসে গেছে । আজ দেখছি নিজের প্রাণের কাঙালপনা, 
দেখছি নিজের নিরুপায় আত্মসমর্পণ । যত কঠিন ছিলুম, ততই নরম হয়ে 
পড়েছি । একটা ভয়ানক মন্ত্রে আমার শরীরে, মনে, চিন্তায়_-স্মস্ত কিছুতে 
ভাঙন ধরেছে, একে রোধ করবার সাধ্য আর আমার নেই । সচেতন মন 
বলছে, এ তোমার কী অধঃপতন হোলো? কিন্তু প্রতিবাদ কানে ঘায় না, 
সঙ্ঞানে তলিয়ে যেতেই ভালো লাগছে । 

তাহার গলা ধনিয়া আদিতেই সে চুপ করিলঃ নচেৎ হয়ত আর9 অনেক 
কথ। বলিয়া! যাইত । জীবনে. বনু রাত্রি বহু রকমে অতিবাহিত কনিদাছি, 
কেমন করি যেন তাহাদের কয়েকটা! মনে পড়িয়া আজ মাথা হেট হইয়া 
আসিতেছে,_অপব্যয়ে, অন্তায়ে আর আত্ম-অবমাননার সেগুলা যে শুধু গণ্য 
তাহা নহে, করুণ ৪ বটে--অথচ আজিকার এই অদ্ভুত ব্রাত্রি আমার জীবনে 
কী বিচিত্র, কিরূপ আশ্চর্যময় ইহার প্রতিটি নিবিড় মুহর্ত। সত্য কথা বলিতে 
বসিয়াছি, অবিশ্বান্ত হইলেও, সত্য বলিব । মুন্ময়ীর সমস্থ দেহ ও মন ভরিয়া 
যদি বা কিছু একটা ইচ্ছা জাগিয়া থাকে, আমার দিক্‌ হইতে তাহার কিছুমাত্র 
চাঞ্চল্য নাই । তাহার সম্মান ও সন্ত্ব-রক্ষার কেমন একটা দারিত্ববোধ এবং 
তাহার সহিত নিজেরও একটা আত্মসম্মান যেন মিলিয়া-মিশিয়া একাকার হইয়। 
গেছে--তাহারই একটা ছুলভ সৌন্দমধ আমি যেন মনে মনে অভিভূত হইয়। 
দেখিতে লাগিলাম । ভাবিলাম এই মেয়েটিকে সম্মান ও শ্রদ্ধ৷ করিয়া চলিবার 
হয়ত প্রয়োজন আছে, সংযম ও শুচিতা রক্ষা করিবার হয়ত মূল্য আছে । 

বলিলাম, মুন্নী, কোথ। যাবে কাল তুমি? মৃন্ম়ী উত্তর দিল, যে দিকে 
হোক যেতেই হবে। 


১০০১ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


এই যে বললে তুমি আমাকে ভালোবাসো, তা হলে যাবে কেমন ক'রে? 

ভালোবাসলে চ'লে যাওয়! ত”' আটকায় না। 

কিন্তু তুমি যে ধরে রাখতেও চাও না, ছেড়ে দিতেও চাও-_সেটা 
কেমনতরবো ? _ 

মুন্ময়ী কহিল. বরং ছেড়ে দেবো, কিন্ত ধরে রাখতে পারব না। 

পারবে না কেন? 

দহ্যকে বশীভূত ক'রে রাখবো এমন ধনরতু ত আমার নেই । 

বলিলাম, কিন্তু তোমাকে যদি আমি ছেড়ে না দিই ? 

সভয়ে মুন্সয়ী বলিল, কী বলছেন? 

আস্কারা পাইয়া পুনরায় কহিলাম, ধরে) তোমাকে ছেড়ে যদি আমার 
অন না! ওঠে? 

তার মানে আনাকে পরিপূর্ণ অপমানের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে 
চান? 

বলিলাম, তোমার মান কিসে যায় আর কিসে থাকে, আমি ত বুঝে 
উঠতে পারলাম না। কিন্তু অকপটে আমি এই কথা বলতে চাই, তোমাকে 
ছেড়ে থাকতে গেলে আমার কষ্ট হবে। 

মৃন্ময়ী কহিল, ছেড়ে ত থাকতেই হবে। 

কেন? 

ধরে রাখার কোনো উপায় নেই, সেই কারণে । 

কেন? 

সে স্পস্টকঠ্ে কহিল, মান্থষের চোখের আড়ালে যদি কিছু অন্যায় ঘটে ₹ 
ঘটুক, আড়ালে-অন্ধকারে যর্দি এক আধট1 জীবন নষ্ট হয়ে যায় তাও সইবে 
কিন্তু সকলের মাঝখানে সকলের নীতিবোধকে বিষাক্ত করব, এই শ্পধ 
আমার নেই । 

বলিলাম, যদি ভদ্রজীবন যাপন করা! যায়? 


১৯০ 


বড়ের সঙ্কেত 


মৃন্ময়ী উঠিয়া .বমিল, ভদ্রজীবনের অর্থ কি? যে-গাছের গোড়াম্ম বিষ 
তার ফল মিষ্ট হলেও তা'তে বিষ মেশানো । ওতে আমার মন ভূলবে না।. 
ভদ্রজীবন? তার ভবিষ্যৎ কি? সন্ত! বিদ্রোহ ক'রে আধুনিক তরুণ-তরুণীর 
মন ভোলাতে চান? ভবিষ্যতের দায়িত্ব কোথায়? সংখ্যাবৃদ্ধি হ'লে কোন্‌ 
সমাজে তাদের আশ্রয় মিলবে? 

মূর্খ হলেও আমার মুখ দিদ্ন! একটা কথ। বাহির হইল, নতুন সমাজ । 

মুররী হাসিয়া কিল, নতুন সমাজ মাকিন দেশেও ছিল, আর তাদের 
স্মাছের চেরে আধুনিক পুখিবীর আনু কোথাও নেই শুনেছি । কিন্ত হঠাৎ 
একদিন এক বাংলা কাগজে পড়লুন যে, ম্যাক্সি গোকীকে তারা সহা কবেনি, 
তাঁর স্ত্রীকে ধ্মপত্রী বলে তারা দানে নি। অত বড় জীবন-তপন্বী এত বড় 
অপমান সরে গেল ওই আপনার নতুন সনাজের কাছে । থামুন, বুলি 
আগড়াবেন না মেরেমাভযের কাছে, মেয়ে হ'লে বুঝতেন ভয়টা কোখায়। 

আমি উঠি্না গিছ্কা তাহার খান্টের একপাশে বপিলাম । তাহায় মাথায় 
হাত বুলাইয়া বলিলাম, যদি বলি তোমাকে সম্পূর্ণ নিম করে তুলতে পারন ? 

মৃন্মপ্ী কহিল, আপনাকে বিশ্বান করবার মতন ত কোন কাজ আপনি 
করেন নি? 

বলিলাম, মীন্ু, অনেক আঘাত করেছ, অনেক খোচা দিয়েছ, আমাকে 
সত্যিই তুমি চিনেছ, লন্দেহ নেই । কিন্তু তরু বল্ছি_-তোমার ভালো থাকা 
মন্দ থাকার ওপর আমার জীবন মরণ নির্ভর করছে। আমি নিজে কিছু 
করতে জানিনে ; এমন মান্ঘকেই আমার দরকার, যে আমাকে দিয়ে সব 
কাজ করিয়ে নিতে পারবে। 

সে কহিল, আমি ত' নে মান্য নয়, জোর করে আপনাকে দিয়ে ত' কিছু 
করিয়ে নিতে পারব না। 

বলিলাম, তুমিই সেই মান্ঠষ। তুমি সব পারো । অতগুলি ছেলেমেয়ের 
দায়িত্ব তোমার হাতে ছিল, নিজের নান-সন্ত্রম বিপন্ন করেও ওদের তুমি 


১১৯ 


ঝড়ের সন্কেত 


চালনা করেছ । এ কাজ মহৎ, এর তুলন! নেই মীন, আমি নিজেও পিছিয়ে 
পড়তে চাইনে অথচ আমাকে এগিয়ে যেতেও ভুমি দেবে না। তাহলে আমি 
কোথায় দাড়ই বলো ত? 

মুন্মপ্ী কহিল, আপনি এত বড় সম্পত্তির মালিক, অত নগন্‌ টাকা, আত্মীয় 
পরিজনের মাঝখানে আপনি মানুষ, আপনান সামাজিক গ্রতিষ্ঠা--আপনার 
মাথার ওপর আজে মা বেঁচে,_আমাকে আপনি এই প্রশ্ন করেন 
কেন? 

আমার ক আবেগে কাপিয়। উঠিল, বলিলাম, সমস্তই আছে, নবাই রয়েছে 
চারিদিকে, কিন্ত্ত আমাকে পথের সন্ধান ত কেউ দেয়নি, মুন্ময়ী? আমার 
এতখানি লাঞ্ছনা, এত বন্ড ত্যাগ ত" কেউ স্বীকার করেনি? এমন যদি মনে 
করো আমার নব দৌষ-ত্রটি শুধরে আমাকে মানুষ করে তোলাই তোমার 
কাজ, তাহলে আমাকে তোমার সব কাজের ভার দাও । 

মৃন্ময়ী কহিল, আমার জন্যে আপনি এত দাম দিতে চান কেন? 

নেক কারণে । পিতৃ্ণ আমি শোধ করতে চাই,_-আমি জানি তোমার 

মা আমাদের অন্যায়কে ক্ষমা করতে গিয়ে নিঃশব্দে মৃত্যু বরণ করেছেন। 
আমার বাবাকে অপরাধী বলতে পারব না, কিন্তু অবশ্যন্তাবী কলঙ্কের দ্বিকে 
তোমার মাকে তিনি যে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, আমি তারই একট! 
প্রতিকার করতে চাই, আমাকে তুমি তারই স্থযোগ দাও । 

মৃন্ময়ীর চোখ দ্রিরা অশ্রু গড়াইরা আসিল। আমি পুনরায় কহিলাম, 
জানি মায়ের লাঞ্ছনার সেই জাল! তোমার বুকের মধ্যে অহোরাত্র জলছে, এও 
জানি পৃথিবীর সব পুরুষের প্রতি তোমার ভয়ানক অভিমান তোমার জীবনকে 
জর্জরিত করে তুলেছে, কিন্তু তবু এই রাত্রে আমাকে বিশ্বাস করো_আমি 
কেবল পিতৃখণই শোধ করতে চাইনে, আমি কেবল তথাকথিত ভালোবাস! 
জানিয়েই মুগ্ধের মতন তোমার দরজায় পড়ে থাকতে চাইনে,_-আমি তোমাকে 
দেশের জনতার মাঝখান থেকে নকল কলঙ্ক আর সকল লজ্জা থেকে তুলে 


৯১২ 


ঝড়ের সন্কেত 


ধরতে চাই গৌরব, আর মহিমার দিকে,_-আমাকে তুমি সেই ভিক্ষা দাও 
মৃন্ময়ী । 

মৃন্ময়ী আর পারিল না, খাট ছাড়িয়া পিছন দিক হইতে আসিয়া ছুই হাতে 
আমার গল] জড়াইয়! ধরিয়া! হাউ-হাউ করিয়া কীদিয়া ফেলিল। মনে হইল, 
তাহার বঞ্চিত বিতাড়িত জীবনের সমস্ত পুগ্তীভূত চোখের জল অশ্রান্ত ধারায় 
নামিয়াছে। 

শান্ত মনে অচঞ্চল চিত্তে সেই রাত্রে তাহার সহিত আমিও চোখের জল 
ফেলিলাম। কোনো বাধ! আর সক্কোচ মানিলাম না, তাহার কাছে বসিয়া 
কাদিতে আঙ্জ আমারও পৌরুষে আটকাইল ন1। 


নয় 


একটি রাত্রি জাগরণেই কাটিল। রাত্রির আলাপ রাত্রিতেই শেষ 
হইয়াছিল, বুঝিতে পারি নাই ভোরের দিকে তন্দ্রা চক্ষু জড়াইয়াছে। শেষ 
অবধি মৃন্ময়ী ঘৃমাইল অথবা কি করিল তাহা জানি না, কেবল এক সময়ে 
অনুভব করিলাম-_-তাহার কোমল করতল আমার মাথার চুলের মধ্যে ঘুরিয়া 
কিরিয়া বেড়াইতেছে। ইহার ভিতরে যে ঘন নরম স্বাদ ছিল, তাহাতে 
নিবিড় হুখস্বপ্নে আচ্ছন্ন হইবার কথ! ; কিন্ত ইহা আমার পক্ষে এতই অভিনব 
যে, মামার সমস্ত ক্সায়ুতত্ত্র ও শিরা উপশিরায় কেমন একট। এক্যতানের বঞ্চনা 
বাজিতে লাগিল। আমি সচকিত হইয়া জাগিয়া উঠিলাম। রাত্রি প্রভাত 
হইয়াছে। 

মুন্ধয়ী কহিল, ওঠো ? 

এই প্রথম সে আমাকে আপন জনের ন্যায় তুমি বলিয়া সম্ভাষণ করিল । 
আমি একটু হাঁসিলাম, কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে আমার ছুই চক্ষু পুনরায় 
সুখনিদ্রায় জড়াইয়া আপিতে চাহিল। তাহার হাতখানা শক্ত করিয়া ধরিয়া 


০১৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


গলার কাছে চাপিয়া রাখিলাম। আজ তাহাকে ভারি অন্তরঙ্জ বলিয়া মনে 
হইতে লাগিল; মনে মনে কি যেন একট] ইচ্ছা! করিতেছিল। 

মুন্ময়ী বলিল, নেশার ঘুম বুঝি সহজে ভাঙতে চায় না? 

বলিলাম, একে নেশার ঘুম, তায় আবার তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে 
দেওয়া__উঠতে ইচ্ছে না হওয়া কি এতই অপরাধ? 

কিন্তু পাপিষ্ঠাকে তাড়িয়ে দেবে বলেছিলে যে? 

হাপিয়৷ বসিলাম, তাড়াবো আর কেমন ক'রে পাপিষ্ঠার ফাদে যে ধরা 
দিলুম-_এই বলিয়া তাহাকে ধরিতে গেলাম, সে সভয়ে পিছাইয়া গেল। 

স'রে গেলে যে? 

হাপিমুখে মৃন্ময়ী কহিল, তোমাকে চুক্তিভঙ্গের অপরাধ করতে দেব না'। 

এমন চুক্তি ত হয়নি যে, তোমাকে আদর করতেও পাবে! না? 

সেট1 অবশ্ই উহা ছিল। নাও ওঠো, সত্যি তামাসার সময় নেই । আর 
একটু বেল হলেই আবার হোটেলওয়াল! হয়ত সাবাদিনের দাম ধরবে। 

তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, মুন্যয়ী, বালবিধবা কাদের বলে জানো ? 
যার! পূর্বজন্মে তাদের ভালোবাসার পাত্রদের অসমক্ষে ঘুম ভাঙিয়ে তোলে । 

মৃন্ময়ী অতিশয় চতুর। পুনরায় হাসিয়া সে কহিল, প্রিয়পাত্র শব্ধটা কিন্তু 
অস্পষ্ট, ওটাকে সহজ ক'রে বলো । 

বলিলাম, এই ধরো প্রণয়পাত্র, অথবা স্বামী । 

তাহার উত্তর দিবার পূর্বে দরজায় আওয়াজ হইল, মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি গিয়া 
দরজা খুলিল। একজন চাঁকর ষোঁড়ঘ উপচারে প্রাতরাশ সাজাইয়া আনিয়াছে। 
এবার আমাকে উঠিতেই হইল। উঠিয়া লক্ষ্য করিলাম- হুন্ময়ী ইহারই মধ্যে 
কখন স্নান সারিয়া লইয়াছে। তাহার সগ্যোক্বাত চেহারায় দ্বিগুণ পজীবতা 
দেখিলাম। 

মুখ ধুইয়া আপিয়! দুইজনে খাবারের টেবিলে বদিলাম। অতঃপর হোটেল 
হইতে বাহির হইয়া আমাদের কতবব্য কি, তাহ! কিছু নির্দিষ্ট ছিল না। আমি 


১১৪ 


ঝড়ের সন্কেত 


মনে মনে ষে কল্পনাটি করিতেছিলাম, তাহ! মৃন্ময়ীর নিকট প্রকাশ করিবার 
সাহম ও স্থযোগ পাইতেছিলাম না। কেমন করিয়া তাহার ভূমিকা করিব, 
তাহাই ভাবিতেছিলাম । 

মৃন্সয়ী বলিল, খেয়ে দেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়তে হবে, এখানে বাসে 
তোমাকে কিন্তু খোষগল্প করতে দেবো ন1। 

বলিলাম, আমি কি কেবল খোষগল্পই করি, মীন? 

সে বলিল, তুমি আর যাই কর, ভবিষ্যতের ভাবন। ভাবো। পুরুষ-মানুষের 
ঘূত মন্ততা কেবল বতান নিয়ে । 

বলিলাম, ভবিয্যঘ আমার এতদিন ছিল না, এখন থেকে তৈরি হোলো। 

কেমন তার চেহারা শুনি ? 

ক্রমশঃ প্রকাশ্য একটি উপন্যাস। যতটা বেরিয়েছে ততটাই পড়া যায়, 
পরিণতিট] কল্পনা করা যায় বটে, তবে খুব স্পষ্ট নয়। 

মুন্ময়ী বলিল, নায়ক-নায়িকার ভাবগতিক দেখে ও বুঝতে পাবো না? 

বলিলাম, মৃন্ময়ী; আধুনিক মনস্তত্ব-বিজ্ঞানের আওতায় তারা গ'ড়ে উঠেছে, 
তাদের মুখের সঙ্গে মনের মিল নেই, মনের সঙ্জে মিল নেই কাজের । 

একট আদর্শ তআছে। 

উদভ্রান্ত আদর্শ। এই যুগের অডিসম্পাতই এই ঘে কোন আদর্শের 
স্ুম্পষ্ট সংজ্ঞ! নেই। কোন একটা স্থারী বিশ্বাণ আর জীবননীতি আজকের 
দিনে গ'ড়ে উঠতে পারতে না বলেই একদিকে তাদের যেখন আম্মবিশ্বাস নেই, 
অন্তদিকে তারা হয়ে উঠেছে তেমনি নীতিজ্ঞানহীন | মনটা তাই স্থিতিশীল 
নয়--যাকে বলে নিত্য আন্দোলিত। 

এই সব কথা কে আমার মুখ দিয়া বলিতেছিল, তাহ। বুঝিতে পাধিলাম 
না। মুন্ময়ীর কথায় সচেতন হইয়া উঠিলাম। সে কহিল, সমাজতন্বের কথা 
এখন থাক্‌। বকৃতে আরম্ভ করলে আৰ ভুমি থামতে চাণ্ডনা। খেয়ে নাও, 
চল বেরিয়ে পড়ি। 


১১৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


প্রাতরাশ শেষ করিলাম। সনের স্থযোগ ছিল, ত্রান করিয়া প্রস্তত 
হইলাম। মৃন্সয়ী কহিল, আমার ন হয় মাথার ওপর কেউ নেই, কিন্ত তুমি 
এই যে বাইরে-বাইরে রয়েছ তোমার মা কিছু বলবেন না ।? 

বলিলাম, তিনি জানেন। 

কি জানেন? 

জানেন তার ছেলের চরিত্র | 

ছেলের চরিত্র যে মন্দ, একথাও কি তিনি জানেন? 

বলিলাম, না। বরং এই কথাই জানেন যে, তার ছেলের চিত্র ব'লে 
কোন পদার্থই নেই। স্ত্রীলোক সম্বন্ধে আমার কিছু পক্ষপাতিত্ব আছে, এ 
তিনি বহুকাল থেকেই লক্ষ্য ক'রে আসছেন । 

মুন্ময়ী কহিল, কিন্ত তিনি যদি আমার কথা শুনতে পান্‌? 

শুনতে পেলে ক্ষতি নেই, তবে তোমার সঙ্গে আমার হ্ৃগ্ভতা ঘটেছে, 
একথা শুনলে তিনি অন্নজল পরিত্যাগ করবেন । 

মৃন্য়ী চোখ ছুইটা অলক্ষে শিহরিয়। উঠিল। কিন্তু কয়েক মুহুরতচুপ 
করিয়া থাকিয়া! সে হ্াপিয়া ফেলিল। কহিল, বেয়ারিং চিঠি দিয়ে মাকে 
জানিয়ে দেবো যে, আপনার ছেলের সঙ্গে আর যাই হোক, হছ্যতা আমার 
একটুও ঘটেনি। 

তামাস। করিয়া কহিলাম, সমস্ত রাত একত্র থেকেও নয়। 

নিশ্চই | 

হৃদ্যতা ঘটবার স্থযোগ দেবে কি? 

না, মহাশয় | 

বলিলাম, তাহ'লে ত' নায়ক-নায়িকার ভবিষ্তৎ বড়ই অন্ধকার দেখতে 
পাই। এর উপায়? 

সৃন্ময়ী কহিল, বেশ ত, বিয়োগাস্ত উপন্যাস জম্ৰে ভাল। 

কিন্ত মিলনাস্ত না হ'লে জনপ্রিয় হবে না যে? 


১১৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


যোগে-বিয়োগে যদি শেষ হয়? 

বলিলাম, দেখা ষাক্‌, সেট! তাদের ক্রিয়াকলাপেই নিদিষ্ট হবে। যাই 
হোক্‌ শোন বলি, উপন্থাসের পরিণতি যাই ঘটুক না কেন, পরিশিষ্ট একট। 
থাকতেই হবে। পথে বেরিয়ে পড়তে বল্ছ, কিন্তু কলকাতার পথ জনবাহুল্যের 
মরুভূমি । এটা রূপকথার দেশ নয় ষে, বনের ফল খেয়ে আর নদীর জল থেমে 
অবাধ স্বাধীনতায় ঘুরে বেড়াবো। এখানে জীবনকে নির্দিষ্ট না করলে 
মৃত্যু । 

কিন্তু মুন্ময়ী আর ইহ! লইয়া আলোচনা করিতে প্রস্তত ছিল না। কেবল 
কহিল, বেশ ত, যদি সৃবিধে কিছু নাই হয়, তোমার পৈতৃক নগদ টাকা আছে, 
আর এই হোটেলের দরজাও খোলা রইল। 

আমি খুশী হইলাম । মুন্সয়ীর জন্য কিছু খরচ করিতে পারিলে আমি 
যেন কৃতার্থ হই। তাহার সেই হাজার টাকা_যাহা তাহার স্বদেশী ভাইরা 
ডাকাতি করিয়া আনিয়াছিল-_তাঁহ|! আমার নিকট গচ্ছিত আছে; সেই 
টাকা তাহাকে যথাসময়ে ফিরাইয়া দিব তাহাতে সন্দেহ নাই। এদিকে টাকা 
নষ্ট করিতে করিতে আমার নিজের একটা ধারণ] জন্মিয়াছে যে, সংব্যয় করিতে 
গেলে অর্থের পরিম!ণ অল্পই লাগে । চরিত্র নষ্ট করিবার পক্ষে সকলের 
বড় অস্থবিধা এই যে, ইহাতে টাকা পয়দা! লাগে অজন্র। সাধারণ লোক 
চরিত্রহীন হইতে পারে না অনেকটা এই কারণে । আমার খুশী হইবার 
দ্বিতীয় হেতু, আজ প্রথম মৃন্ময়ী আমার টাকা নিজের জন্য খরচ করিতে স্বীকৃত 
হইল। 

ভোঁটেলওয়ালাকে ডাকিলাম। একনাত্রির আহার ও বাসস্থান এবং 
জলযোগ প্রাতরাশের জন্য সবশুদ্ধ প্রায় চৌদ্দ টাকা হইল। অতএব 
চাকরের বকৃশিস সমেত পনেরোটি টাকা ব্যয় করিয়া আমরা 
পুনরায় দুর্গা বলিয়া পথের সমূত্রে ঝাপ দিলাম। বেল! আটটা বাঁজিয়াছে। 
কলিকাঁতার লোক-কোলাহল তখনও ধম্তিলা ও চীাদ্নীতে ঘন হয় 


১১৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


নাই__বসম্তকালের রৌদ্রের সহিত মধুর হাওয়া তখনও মুখে চোখে ন্সেহের 
স্পর্শ বুলাইতেছে। দুইজনের দিকে চাহিয়া সম্ভবতঃ দুইজনেই যেন অনুভব 
করিলাম, রাজপথের ফুটপাথের প্রান্তে ওই স্থরক্ষিত গাছগুলির চিক্কণ সবুজ 
পত্রাবলীর ন্যায় আমরাও যেন আজ একটি নৃতন জীবন পাইয়াছি। এই 
চলমান লোকযাত্রার নিত্যকর্মে আমরাও হয়ত কিছু-কিছু সাহায্য করিতে 
পারি। আজিকার সকালে আকাশ ভরিয়! মধুক্ষরা বসন্তকাল নামিম়াছে, 
আমরা যেন তাহারই আবেশ চোখে মুখে মাখিয়া পরস্পরকে নৃতন করিয়! 
আবিষ্কার করিলাম। অপরিসীম তৃপ্তি লইয়া ছুইজনে পূর্বদিকে চলিলাম। 
মৃন্ময়ী কহিল, একটু তাড়াতাড়ি এস। 

বলিলাম, কতদূর যাবে? 

সে মুখ ফিরাইয়া বলিল, হেটে গেলে আধঘন্টা লাগবে । কিন্তু তাড়াতাড়ি 
যেতে হবে। 

কোথায়? 

আপাতত থাকার ব্যবস্থা করতে হবে ত? 

তাহলে গাড়ী করে চল। 

মৃন্ময়ী রাজি হইল। আমি একখানা ট্যাক্সি করিলাম। ট্যাক্সিকে দে 
নির্দেশ দিল । তাহাকে প্রশ্ন করিলাম না। এমনি করিয়াই সে আমাকে 
অনেক জায়গায় লইয়া গেছে, আগে হইতে কোন ৫কফিয়ৎ সে দেয় নাই। 
এই শহরে তাহার বহু পরিচিত জায়গা, বু সমাজে তাহার অবারিত আনা- 
গোনা । ট্যাব্সি ছুটিয়া চলিল। 

আধঘণ্টার হাটাপথ গাড়ীতে পাচ সাত মিনিটের বেশী লাগিল না। 
এণ্টালীর এক এ্যাংলো ইগ্ডিয়ান পল্লীর ধারে আসিয়া সে গাড়ী থামাইল, 
গাড়ীর মীটারে মাত্র বারো আনা উঠিয়াছে। ভাড়া চুকাইয়া আমি নামিয়া 
তাহার পিছনে পিছনে চলিলাম। ইট-বাধানো একটা! সরু গলির ভিতর দিয়া 
সে অনেক দূর চলিল, পরে এক বাড়ীর দরজার কাছে আমাকে অপেক্ষা করিতে 


১১৮ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


* বলিয়া সে ভিতরে প্রবেশ করিল। বাড়ীটা প্রকাণ্ড এবং ভিতরে নানা নর- 
নারীর ক শুনিয়া আমার ধারণাট! ভাল হইল না। নিক্ষিয় গাড়াইয়া থাকিতে 
আমার বিরক্তি বোধ হইতে লাগিল অথচ মৃন্সয়ী ভাকিতে পারে, এই ভাবিয়া 
বড় রাস্তার উপর গিয়া দাড়াইতেও মন উঠিল না। 

দীর্ঘ দশমিনিট পরে আসিয়া সে আমাকে ডাকিল! পাছে কথা কহিলে 
বিরক্তি প্রকাশ পায়, এজন্য নিঃশব্দে তাহাকে অন্গস্রণ করিলাম । সে 
আমাকে অন্দরমহলে লইয়া গেল। এইটুকুর ভিভরেই দেখিতে পাইলাম, 
ভিতরে বু নরনারীর আনাগোনা থাকিলেও কাহারও সহিত কাহারও 
সম্পর্ক নাই, একত্র সকলে থাকিলেও বালুকণার ন্থায় প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন। 
ইহাদেরই ভিতর মৃন্ময়ী কোথায় তাহার সম্পর্ক পাতাইয়] রাখিয়াছে ভাবিয়া 
বিস্ময়ে আমি চমতকত হইলাম । 

দ্বিতীয় মহলের দালানের কাছে আসিয়া একটি মহিলার দেখ! পাইলাম । 
মৃন্ময়ী আমাদের উভয়ের পরিচয় করিয়া দিল, ইনি রাজেনবাবু__ইনি হচ্ছেন 
আমাদের মলিনাদি।_তারপর আমার দ্বিকে ফিরিয়া সে পুনরায় কহিল, বোধ 
হয় বুঝতে পাঁরলে না, ইনিই শ্রমিক-নেত্রী মলিন! মিত্র। 

আমি লচকিত হইয়া উঠিলাম, বলিলাম, ওঃ আপনি? কাগজে দেখছিলুম 
আপনার নামে একট। মামলা চল্ছে না? 

মলিনাি হাসিমুখে কহিলেন, আজ্ঞে হ্যা-_আসম্থন আমার ঘরে। 

পাশেই বড় একটা হল্-ঘবে তিনি আমাদের লইয়া গেলেন। সুসজ্জিত 
হল্‌.ঘর। দেয়ালে পৃথিবীর বহু শ্রমিক-নেতার চিত্র ও “প্লোগান্ বাধাইয়া 
ঝুলাইয়া রাখা হইয়াছে। একপাশে সেত্রেটেরিয়েট টেবল, স্তপাকার ফাইল 
ও অন্তান্ কাগজপত্র, মেঝের উপর নানান দেশের সংবাদপত্র । ঘরের একদিকে 
স্থননর কার্পেট পাতা । মলিনাদি সেই ফরাসের উপর আমাদের বসাইয়। 
কহিলেন, এটা আমার পড়াশুনার ঘর, এখানে প্রাইভেট মিটিংও হয়। 

হাসিয়া বলিলাম, পুলিসের উৎপাত নেই? 


১১৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তিনি বলিলেন, উৎপাত নেই ; কিন্তু যাতায়াত আছে । . এখানে গোপনীয় 
কিছু নেই, শক্তিশালী, প্রতিষ্ঠান হ'লে গোপন করবার কিছু থাকে না । মীন, 
ও ঘরে গিয়ে চা ক'রে আনো । 

মুন্ময়ী চলিয়া গেল। 

তাহার মাথায় ঘোমটা দেখিয়া আমি ফস্‌ করিয়া প্রশ্থ করিলাম, আপনার 
স্বামী কি করেন? , 

মলিনাদি হাসিমুখে কহিলেন, আমার এইসব কাজকর্ম তার পছন্দ নয়, 
সেজন্য আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। তিনি খুবই উচ্চপদস্থ ভদ্রলোক, তার 
মন্তবড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, শুনেছি সম্প্রতি আবার বিবাহ করেছেন । 

তাহার সহজ ও অনর্গল আলাপ শুনিয় যেমনই বিম্মিত হইলাম, তেমনই 
ষেন নূতন আলো চোখে পড়িল। কিন্তু কথা যখন এত সহসা উঠিল, আমিও 
চুপ করিয়! থাকিলাম না । বলিলাম, হিন্দু আইনে কি বিবাহ-বিচ্ছেদ আছে ? 

মলিনাঁদি কহিলেন, না, এই দুর্ভাগা দেশের সেই নমৌভাগ্য এখনও হয়নি । 
তবে তিনি দলিল তৈরি ক'রে আমার ওপর তার সমস্ত দাবীদাওয়! ত্যাগ 
করেছেন। 

বলিলাম, এজন্যে আপনার সামাজিক অস্থবিধা ঘটে না? 

উচ্চকণ্ে হাদিয়া তিনি ঘর ভরিয়! তুলিলেন, সেই হাসিতে আমার ভিতর- 
কার সমাজনীতিসম্পন্ন ব্যক্তিটি কেমন যেন ভয় পাইয়া গেল। আমি নতমস্তকে 
চুপ করিয়া গেলাম । লেখাপড়া ভাল করিয়া না শিখিলেও ইহা জানিতাম-_ 
সমাজন্ষি মেয়েদের হাত দিয়া হয় নাই? পুরুষের মন যেদিন বহু মানবের 
কল্যাণের প্রতি চেতন হইয়! উঠিল, সেইদিনেই সমাজ নামক বস্তটির স্ত্রপাত। 
যুগে যুগে সমাজের আমুল পরিবত'“ন ঘটিয়াছে মেয়েদের স্বার্থের দিকে চাহিয়া, 
উহা! পুরুষের প্রয়োজনের দিক হইতে নহে । এই আবহাওয়ার মধ্যে মুন্সয়ীকে 
আনিয়া আমার যেন কেমন দুশ্চিন্তা তইল; ইহার বিষাক্ত প্রভাব হইতে 
তাহাকে বাচাইয়া দূরে পলাইবার জন্ত আমার সমস্ত মন যেন যুদ্ধ ঘোষণ। করিয় 


মি 


৯২০ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


উঠিল। যদিও চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম কিন্তু আঘাতের পর আঘাত 
করিবার জন্য আমার কুটবুদ্ধি কেবল স্থযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিল। 

বলিলাম, আচ্ছা, শুনেছি শ্রমিক আন্দোলনে নেমে অনেকে নিজের 
স্বার্থোন্ধার করে, একি সত্য ? 

মলিনাদি হাপিয়। বলিলেন, ধারা করেন, তাদের পক্ষে আমি কিন্তু আপনার 
কাছে ওকালতি করব না। হয়ত কেউ কেউ করেন তবে তাই নিয়ে সমস্তটা 
বিচার কর চলে ন1। 

শুনেছি এর মধ্যে অনেক জাল জুয়াচুরি আছে। 

তিনি পুনরায় হাসিলেন। বলিলেন, কিন্তু যেখানে নেই, সেখানে আপনার 
সহানুভূতি আছে ত? 

আমি হানিলাম। বলিলাম, আপনাদের কার্দ ত কেবল ধম'ঘট করিয়ে 
বেড়ানো»--এতে নামডাক অবশ্ত অবশ্য কিছু আছে । যাকে বলে খাতিলাভ। 

মুন্ময়ী তিন পেয়াঁল! চ1 করিয়। আনিল। তারপর কহিল, মলিনাদির সঙ্গে 
ঝগড়া করবার জন্বে তোমাকে কিন্ত এখানে আনিনি । খ্যাতিলাভ নিশ্চয়ই 
অগ্থ এবং তার সঙ্গে টাকাও পাওয়া যায়। তুমিকি বলতে চাও 
তাই বল। 

এমন সময়ে টেলিফোন্‌ বাজিয়৷ উঠিল । মলিনাদি উঠিয়া একটা পার্টিশনের 
মধ্যে ঢুকিয়া টেলিফোন ধরিয়া কথা কহিতে স্থুরু করিলেন । 

বলিলাম, ঝগড়া নয় মীন্ুু, জানতে চাইছি সব। 

ুন্ময়ী চুপি চুপি কহিল, গর চেহারাটা দেখে বোধ হয় তোমার কিছু অশ্রদ্ধা 
জন্মেছে, কিন্তু রতনপুরের রাঞ্জার মেয়ে আর যাই হোক জোচ্চ,রিতে হাত 
পাকাবে না। তুমি গুঁকে চিনতে পারনি । 

কথাটা মিথ্যা নয়। মূলিনা নামের সহিত তাহার রূপের সাদৃশ্ঠ ছিল। 
আর যাই হোক, রাঁজকন্া বলিয়! বিশ্বাস কর! কঠিন । একটু অবাক হইয়া 
বলিলাম, অত বড়লোকের মেয়ে অথচ এই ভাবে-_ 


৮২৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মৃদ্ময়ী কহিল, তুমি প্রায়ই দেখবে সাম্যবাদী আর শ্রমিক নেতা বহু জায়গায় 
বেশ অবস্থাপন্ন। ধনিকের চেহারাটা কাছে থেকে সুস্পষ্টভাবে না জানলে 
তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাড়ান! কঠিন । 

বলিলাম, শ্বামীর সঙ্গে তোমার মলিনাদির বনিবনা হয়নি, তাই বোধ হয় 
লীভারি করতে এসেছেন, সত্যি কিনা বল ত? 

মৃন্ময়ী বলিল, মোটেই না । ছোটবেলা থেকেই ওই | বাপের বিরুদ্ধে 
রাজ্যের প্রজাদলকে উত্তেজিত করেছিল, বিয়ের পরে স্বামীর ব্যবসার 
কমচারীদের নিয়ে দল পাকিয়েছিল-_-আজ দাড়াতে চায় দেশের সকল 
ধনাঢ্দের কৃনীতির বিরুদ্ধে। ওর স্বস্তি নেই, ওর শাস্তি নেই__্বামীর কাছে 
পাওয়া লক্ষ টাকা এই কাজে ওর খরচ হয়ে গেল । ওর হৃদয় অনেক বড়। 

বলিলাম, বুদ্ধিটা সেই অন্থপাঁতে ছোট । হৃদয়ের কারবার ক'রে অনেক 
নির্বোধ নেতা৷ দেশের সেট্টিমেন্ট, ভাঙিয়ে হাততালি 'পায়-_-এর প্রমাণ বাংল! 
দেশ। এখানে কাজের চেয়ে কথা বেশী, আন্দোলনের চেয়ে বেশী চোখরাঙানি । 
তোমার মলিনার্দি লক্ষ টাঁকা খরচ করার পরেও যে তিমিরে সেই তিমিরে। 
টাকার চেয়ে বড় বুদ্ধি, আর হৃদয়ের অপেক্ষা বড় আন্তরিক উৎসাহ । 

টেলিফোন ছাড়িয়া মলিনাদি আসিয়! চা খাইতে বসিলেন। বলিলেন, 
আপনার শোষর কথাটা আমার কানে গেছে, বোধ হয় আপনি আমাকে 
শুনিয়েই বল্পেছেন। কিন্তু আপনি বোধ হয় বুঝতে পারেননি ষে, বুদ্ধি আর 
আসন্তবিক উংসাহুকে চালনা করে টাকা । যারা ধমণঘট করায় আর মেটায়, 
তেমন এক শ্রেণীর পেশাদার নেতা আছে, সন্দেহ নেই; তাঁরা সব দেশে 
চিরদিনই থাকে--তাদের কাজ দরিদ্রদের জীবনের ছেঁড়া কাথায় জোড়াতালি 
দেওয়!, তাদের কথা আমি ধরিনে। 

আমি মারমুখী হইয়া উঠিলাম। মুখে হাসি আনিয়া বলিলাম, আপনার 
কাছে রাজনীতির পাঠ নিতে আমার আপত্তি নেই, ঘর্দি তার সারবত্তা 
থাকে । | 


১২২ 


ঝড়ের সন্কেত 


মলিনাদি আমীর দিকে মুখ তৃলিলেন। তাহার রং কালো, চোখ ছুইটা 
আরও ঘন কাঁলো-_কিস্ত সেই চোখে কোন বড় প্রতিভার বিদছ্যুজ্জাল৷ নেই, 
নিতান্তই বাঙ্গালী মেয়ের স্সেহার্র দৃষ্টি। এক পলকেই বুঝিলাম_ তাহার 
ভিতরে কোথায় একটা দৃঢ আত্মবিশ্বাস আছে, যেখানে আমার কোন আঘাত 
পৌছিতে পারে না। তিনি বলিলেন, আপনি বোধ হয় বিশ্বাস করেন না যে, 
মেয়েরা নেতা হতে পারে ? | 

বলিলাম, মেয়ে এক জিনিস, নেতা আর এক জিনিস। 

তিনি হাসিয়া! উঠিলেন, অর্থাৎ নেতা তার1 কোনকালেই নয়। 

বলিলাম, অনেকটা বটে কারণ তারা মেয়ে । 

বেশ শুনুন, আমি নেতা নই, আমি কর্মী--আর কর্মী হওয়াই ভালো । 
বাংল! দেশে নেতা কারা, জানেন? যাদের বিবৃতির পড়ে প'ড়ে আমর! ক্লাস্ত 
হই । অর্থাৎ কাজ নয়, কথা! তারাই নেতা যাদেয় বিবৃতির সংখ্যা বেশী 
আমি কর্মী, এই আমার গৌরব। আর কর্মী হিসেবে আমি যা বুঝি তাই 
আপনাকে জানাতে পারি । আমি বিশ্বাস করি-_মজুর ক্ষেপানো আর চাষী 
খোচানো শ্রমিক আন্দোলন নয়। তারা অল্পে তুষ্ট হয়, তাদের সেই চিন্তা- 
দারিদ্র্য দূর করা দরকার । আমাদের দেশে আজে শ্রমিক আন্দোলন হয়নি, 
হয়েছে বেতন-বুদ্ধির আন্দোলন । অর্থাৎ তার! কষ্টে আছে, তাদের কিছু স্বন্তি 
দাও । নেতাদের কাজ ওখানেই শেষ হলো- কিন্তু দেশের কাজ বাকি রয়ে গেল। 

বলিলাম, আপনি কি চান্‌? 

তিনি হাসিমুখে বলিলেন, এটা রাজ নীতির কথা নয়, আদর্শের কথা । এ 
কথা দামান্ত, অতি দাধারণ। শ্রমিক আন্দোলনও নয়, হরিজন আন্দোলনও 
নয়, জাতিয় আন্দোলন। শ্রমিকরা বেশী মাইনে পেলে খুশী আর চাষারা বেস 
ফসল পেলে খুশী। একদল চেয়ে থাকে ধনিকের প্রসন্ন মুখের দিকে আর অন্য 
চেয়ে থাকে আকাশের দিকে । এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া 
দরকার। 


১২৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


বলিলাম, আর আমাদের অবস্থা ? 

মলিনার্দি কহিলেন, আমরা? আমর! ত সবাই প্রাক্তন ধনাঢ্যদের 
ভগ্নাংশ । আমাদের রক্তের ভিতরে আছে সেই পু'জিওয়ালাদের প্রবৃর্তি-_ 
লেইজন্য কেবলি চেষ্ট। করি ব্যক্তিগত ভাগ্যের উন্নতি করতে । তার সাক্ষী 
চেয়ে দেখুন নতুন কল্কাতা শহরের দিকে । স্থাবর সম্পত্তি আর ব্যাঙ্কে 
অমানতি টাকা বাড়িয়ে তোলার কুৎসিত লালসা চতুদিকে। স্বাধীনতা 
আমর! পাঁব সন্দেহ নেই; কিন্তু তার পরিণতি হবে দেশের মধ্যে প্রকাণ্ড 
অন্তবিপ্নব দিকে দ্রিকে তারই সুচনা । 

মুন্ময়ী এতক্ষণ পরে কথা কহিল। বলিল, মলিনাদি, তুমি কি মনে কর 
আমরা মেদিন থাকবো? আজ যদি নিজেদের মেই ভাবী বিপ্লবের উপযুক্ত 
ক'রে গড়তে না পারি, তবে সেই সাগর তরঙ্গের সঙ্গে আমরাও যাবে। অগাধে 
তলিয়ে । 

আমি মুন্মমীর দিকে চাহিলাম। তাহাকে চিনিতে পারিলাম না। 
যাহাকে রাতে দেখিয়াছি যাশহাকে ভালবাসায় উদ্বেলিত হইতে লক্ষ্য করিয়াছি, 
সেই মেয়ের চোখে সহসা দেখিলাম--এক ঝলক আগুন ঠিক্রাইয়া পড়িল। 
আমি ভয় পাইলাম। ইহাদের এই বিচিত্র জীবনের সহিত আমার কখনই 
পরিচয় ছিল না, এক ভাবে চলিতে চলিতে সম্পূর্ণ বিপরীত জগতে আসিয়া 
পড়িয়াছি--আমার অতীত জীবনের যাহ! কিছু ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি, 
সমস্তই শিথিল হইয়া খসিয়া! পড়িতেছিল। আমি যেন ধীরে ধীরে অদ্ভুত 
একটা অজানা পথে নামিম়া! পড়িতেছিলাম । 

মলিনাদি কহিলেন, আপনি বিশ্বাস করুন রাজেনবাবু, মৃন্ময়ীও এই কাজে 
ওর সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে,-ধর্মঘট আমরা করিয়ে বেড়াই নে, বিবৃতি 
ছড়িয়ে নেতৃত্ব করিনে- আমরা দেশের দরিদ্র আর শিক্ষাহীনদের জন্যে লেখা- 
পড়া আর আদর্শপ্রচারের কেন্দ্রে কেন্দ্র ঘুরে বেড়াই । ওই আমাদের সাস্তবন! 
_-একদিন যেন ওরা বুঝতে পারে যে, ওরা কারোই আশ্রিত নয়--বরং ওদের 


১২৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


আশ্রয়ে আমরা, ওদেরই আশ্রয়ে সবাই--হোক তারা ইংরেজ, হোক কন্গ্রেস, 
হোক ভারতের তার! ক্রোড়পতি,_-হোক তারা জমিদারসম্প্রদায়। ওরা যেন 
বুঝতে পারে__ওদেরই সম্মিলিত কল্যাণের জন্য আমরা সবাই ওদেরই 
দাসত্ব করি। রাজেনবাবু, মৃন্সয়ী বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারেনি, কিন্ত 
ওরও জীবনের সর্বোচ্চ ধর্ম এই । আপনাদের মধ্যে ভালবাসা যদি প্ররুত 
আর পবিত্র হয়--তবে এই আদর্শ ছাড়া আপনাদের সামনে আর কোন পথ 
খোলা নেই 1--বলিতে বলিতে তাহার কালো মুখ কেমন একটা সৌন্দষে 
উদ্দীপ্ত হইয়! উঠিল । 

বলিলাম, আপনার] কি চান আমি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে দেশের কাজ 
করতে নামবে।। 

মৃন্ময়ী কহিল, এত; দেশের কাজ নয়-_-এ কাজ তার চেয়েও বড়, এ দেশের 
মানুষের সেবা। 

আমার কি শক্তি আছে? 

মলিনাদি কহিলেন, দধীচি মুনির কঙ্কাল নিয়ে বজ তৈরী হয়েছিল। 

কিন্ত আমার সঞ্চয়? 

যদি কিছু থাকে ত ষথাসর্বন্ব দিন; যদি না থাকে, তবে খালি ছুই হাতে 
কাজ তুলে নিন্‌। 

আপনারা কি মনে করেন আমার দ্বার৷ কোন বড় কাজ হ'তে পারে? 

মৃন্ময়ী কহিল, তুমি ত” অনেক অসাধারণ কাজ করেছ যাবড় নয়? এখন 
নিজের কাজ করতেই কি তুমি ভয় পাবে? 

চমকিয়া বলিলাম, নিজের কাজ? 

যে-কাজে সকলের ভাল হয় সেই ত নিজের কাজ,_-একথা তুমি যে সেদিন 
বললে? 

কি বলিয়াছি তাহ মনে পড়িল না, কিন্তু এই ছুইটি নারীর সম্মুখে বসিয়া, 
আরম মন শিখার ন্তায় কাপিতে লাগিল। মানুষের জীবনে কোন কোন 


১২৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মুহুতেকি যে বিপ্লব ঘটিতে পারে, কেমন করিয়া যে ভূমিকম্পে সমস্ত ধুলিসাৎ 
হইতে পারে, তাহাই কেবল জাগ্রত চেতনা দিয়া উপলব্ধি করিলাম। আজ 
ভালবাপার মূল্য দিবার সময় আসিয়াছে । সমস্ত আকাশ ভরিয়া ঝড়ের ভ্রকুটি 
দেখা দিল। 


দশ 


যে জগত আমার পরিচিত, সেখান হইতে উৎক্ষিপ্ত হইয়া কোন্‌ অজানা 
জগতে যেন ছিট্কাইয়! পড়িলাম। এখানকার সমাজ, চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা 
ও আদর্শের অলিগলি পথ আমার চেনা নাই, সেই জন্ত কোনো দিক্‌ হইতেই 
যেন বেশ আল্গ!। হইয়া! হাত-পা ছড়াইয়া কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে 
পারিলাম না। 

কিন্তু ওইটি আমা'র পক্ষে স্মরণীয় মুহূর্ত। যে-মুন্ময়ীকে আমি উল্টাইয়া 
পাল্টাইয়। দীর্ঘ এক বৎসরকাল লক্ষ্য করিয়া আসিলাম, যাহার প্রতিটি নিশ্বাম, 
প্রতিটি রক্তবিন্দুর ইতিহাস আমি আয়ত্ব করিয়াছি, যাহাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস 
করিয়া একান্তভাবে পরিপাক করিয়াছি, সহসা সে যেন পুনরার বিশ্ময়রূপে 
দেখ! দিল । মন বস্তুটি যে বিচিত্র ইহাতে সন্দেহ কি? খুঁড়িতে খুঁড়িতে 
অগাধে তলাইয়া ইহার আকর হইতে কতযে অদ্ভুত মণিরত্ব আহরণ করি 
তাহার ইয়ত্তা নাই। মৃন্ময়ী একদিন আমাকে বলিয়াছিল, তুমি ছোট নও, 
তুমি অনেক বড়। ইতর জীবনযাত্রায় তোমার মৃত্যু ঘটে নাই, কারণ 
মানুষের ভিতরে যে আসল মান্য তাহার গায়ে কাদা লাগে না, সে 
তার সমস্ত মালিন্কে অস্বীকার ক'বে মাথা তুলে দাড়ায়। প্রাণের যে দেবতা 
তাঁর হোমাগ্সি অনির্বাণ উজ্জল, সেই আগুনে বারে বান্দে আমাদের সকল অন্তায় 
পুড়ে ছারখার হচ্ছে। মৃন্ময়ী সেদিন সত্য বলিয়াছিল কিনা জানি ন। কিন্ত 
তাহার সেই বাণী শুনিয়া আমার মাৎসর্ধমগ অর্বাচীন মন রোমাঞ্চিত হইয়া 


১২৬ 


বড়েব সঙ্কেত 


উঠিয়াছিল। নিজের প্রতি কেমন যেন শ্রদ্ধা বাড়িল। আজ আমার ভিতরে 
যে ঝড় উঠিয়াছে তাহাতে যেন অনেক অপরিচিত উড়ে! চিন্তার টুকরা দেখিতে 
পাইলাম। একথা স্বীকার করিতে কুন্তিত হইব না যে, ত্্রীলোকের নিকট আমি 
অনেক শিক্ষা পাইয়াছি। তাহারা আমাকে পাপ করিতে শিখাইল, বিহ্বেষ) 
হিংতা ও কলঙ্ক কাহাকে বলে জানাইল, নীচে টানিয়া নামাইল, দ্বণা, ভয় ও 
'অসম্মানের পথ দ্রেখাইন্পা দিল,_-মাজ আবার তাহাপ্রাই সন্ধান দিতেছে, সেই 
পথের, যে-পথ মহিমা ও অমরত্বের দ্রিকে গিয়াছে; ভালোবাসার অপেক্ষাও 
যাহ। বড়, সেই বুহতের কল্যাণ পথের সন্ধান দিতেছে । 

মলিনাদির পাশে বসিয়া মুন্ময়ীর মুখে যাহা শুনিলাম, সেটি ষেন অগ্নিষন্ত্র) 
অমন করিয়া কোনো কথাই আগে আমি শুনি নাই । কয়েকটি শববিন্যাসের 
[ভতবে কেবল যে অগ্নিই ছিল তাহাই নয়--অপরিমেয় শক্তি, যাহ! বজের 
কাঠিন্য দিয়া প্রপ্তত,_সেই শক্তিও ছিল। ওইটি আমার স্মরণীয় মুহূত্ত”। 
ওই মুহূর্তে যে বিছ্যুজালা জলিয়া গেল, সেই প্রলয়ের আলোয় কেবল যে 
ন্ময়ীর মুখের চেহারায় অগ্নিরূপিণী নারীকে দেখিলাম তাহাই নয়, সেই আলোয় 
নিজেকেও প্রকাশিত হইতে দেখিলাম। চোখের সম্মুখে দেখিলাম, 
ভালোবাদার সহিত দেশের সেবাকে মিলাইয়া সে দেখিবে ইহাই তাহার সাধনা । 
প্রেমকে সে ছোট করিয়া সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিবে না; দেশের দুর্গমের দিকে, 
রাজনৈতিক লাঞ্ছন! ও ছুঃসাহপিক দেশসেবার পথে প্রেমকে সে প্রসারিত কবিষ্ণা 
দিবে। নইলে ভীলোবাসা! তাহার মিথ্যা, জীবন তাহার তুচ্ছ। 

একটি সম্পূর্ণ বৎসর মৃন্ময়ীকে লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইলাম। শৈশবকালে 
তাহাকে ভালোবাপিতাম ক্রীড়নকের মতো । যেদিন হইতে তাহাকে দেখিলাম 
না, সেইদ্দিন অবধি নৃতন খেলা পাইয়া দাতিয়৷ উঠিলাম, তাহার জন্ত কোনো 
উদ্বেগই অনুভব করি নাই। প্রকাণ্ড এই সংসারে কোথায় সে হারাইয়া গেল। 
আজিও সে অনাদূত। মাতৃকুলের কলঙ্ক বহন করিয়া পথে পথে সে ঘুরিয়া 
বেড়ায়। জাত্যাভিমানের সংস্কার সে রাখে নাই, সকল জাতির কাছেই পাত 


৯২৭ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


পাতিয়া সে খাইয়া বেড়ায় । সামাজিক পরিচয় তাহার নাই, বড় একটা গাছের 
ছায়ায় থাকিয়া অহঙ্কার প্রকাশ করিবার মতোও কিছু তাহার নাই, তাহার এস্বর্য 
নাই, অর্থ নাই-_তাহার জন্য কাদিবার অথব। ভাবিবার মানুষও আজ অবধি 
দেখিলাম না। পথে পথেই তাহার বাসা ; পথে পথেই তাহার নিত্য যাওয়া 
আসা । তাহার সম্বলের মধ্যে ছোট একট স্থুটকেস, দু'চারটি শাড়ী অথব। 
জামা, হয়ত গোট। ছুই টাকা, হয়ত ব1 একখান! মাথার চিরুণী-_কিন্তু এই 
তাহার অনেক, ইহার বেশি থাক! সে প্রয়োজন মনে করে নাই, ইহার অতিরিক্ত 
কিছু রাখা সে দেন্ত মনে করিয়াছে । আজ যদি বা আমাকে কেন্দ্র করিয়া 
তাহার অবস্থাস্তর ঘটিবার সম্ভাবন৷ দেখ! দিয়াছে, সে তাহার বজ্রকঠিন স্বাতন্থ্যকে 
প্রকাশ করিয়া ফেলিল। সচ্ছন্দ সংসার, সচ্ছল জীবন, নিরুছের প্রত্যহের 
স্থখযাঁপন, নিশ্চিন্ত দিবারাত্রির নিভৃত বিলাস ও সম্ভোগ-_ইহ1 তাহার গতিশীল 
জীবনের পক্ষে প্রকাণ্ড একটা অবরোধ,__এগুলির মধ্যে মে বন্দীষস্থণা অনুভব 
করিবে । তাহার কল্পনা ও কামনা অনেক বড়, অনেক বড় কাজ তাহার বাকি, 
-_এই দৈব ক্ষুধা মিটিবার পূর্বে তাহার শাস্তি নাই, তৃপ্তি নাই, নিদ্রা নাই, 
বিশ্রাম নাই। দেশের কাজ লক্ষীছাড়ার কাজ, কিন্তু তাহাতেই মুন্ময়ীর 
আনন্দ । জন্তর মতে। আত্মগোপন করিয়া থাক, নিত্য লাঞ্চনার শঙ্কায় শঙ্কিত 
মন, দারুণ অভাবের মধ্যে নিজেরই অশ্রু অঞ্জলী ভরিয়া পান করা, সুখসাচ্ছন্দ্য 
পরিহার-্করা বৈরাগী জীবন, স্থান হইতে স্থানান্তরে বিতাড়িত হইয়া আনন্দ 
পাওয়া,_-এই নকল ব্যাপারেই তাহার মন উল্লসিত হইয়া উঠে। কেহ কোথাও 
একট! স্বপ্ন লইয়া মাতিয়াছে, কেহ ঘর ভাডিম়! ছুবন্ত খেলা খেলিতেছে, কেহ 
সর্বস্ব ফেলিয়া! দুর্গম মেরুপথের মৃত্যুর দিকে ধাবিত হইয়াছে, কেহ কোনো 
একটা কাল্পনিক আদর্শের জন্য পড়িয়! পড়িক্ন মার খাইতেছে-_ইহাতে মুন্সীর 
বুকের রক্ত তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে। আমার সংস্কারব্ধ মন এক এক 
সময় ভাহার মনের চেহারা দেখিয়া ভয় পায়-_যেমন অন্ধকারে উত্তাল-তরজ 
সমুদ্র দেখিলে অন্তর ধক ধক করিতে থাকে। বুদ্ধির সীমানার মধ্যে," যুক্তির 


১২৮ 


ঝড়ের শঙ্কেত 


শাসনের মধ্যে আমি তাহাকে আটিয়৷ উঠিতে পারি না। যে সমস্যা ও প্রশ্থ 
লইয়া পৃথিবীর সকলে ট্রিক সাফল্যের দিকে ছুটিতেছে, মুন্ময়ীর একটি ছোট 
হাসিতে তাহা যেন ধূলিসাৎ হইয়া যায়। 

চৈত্রের দুপুরে একদিন আদি তাহাকে লইয়া বাহির হইলাম। মলিনাদির 
কাছে সে অধুনা বাস বাধিয়াছে, স্থতরাং আপাতত আশ্রয়ের সমন্যা তাহার 
নাই। কয়েকদিন একটু যত্ব পাইয়া তাহার স্বাস্থ্যের চিক্কণ ফিরিয়া আসিয়াছে, 
তাহার সুন্দর দেহের কঠিন নিটোল গঠন আমার মনে পথ চলিবার উৎসাহ 
আনিতেছিল। রৌদ্র খরতর, পথ জনবিরল, যানবাহনের গতি মন্থর, 
আমাদের দিকে ফিরিয়া তাকাইবার অথব1 ওতস্ক্য বোধ করিবার মতো 
জনতা পথে কোথাও ছিল না। 

প্রণয় ও বনুত্বকে প্রগাঢ় করিয়া তুলিবার যে অবকাশের প্রয়োজন, সে- 
প্রয়োজন আমাদের আর ছিল না। ভালোবানা লইয়া যে চৌধবৃত্তি, যে 
হাশ্যকর লুকোচুরি, যে সঙ্গোপন ইতরবৃত্তি--তাহা হইতে মন সরিয়া গেছে, 
তাহার অলীকতা প্রত্যক্ষ করিয়াছি, নিজেকে অপরাধী মনে করিয়া! লোকচক্ষু 
এড়াইয়৷ চলিবার রুচি আর নাই, এখন জীবনের উখান-পতনের সমস্থ 
নিষ্পত্তি করিবার সময় আসিয়াছে । বসারণ শাস্ত্রের কথা শুনিয়াছি। 
এক পদার্থের সহিত আর এক পদ্াথ মিশ্রিত করিলে তৃতীয় রসের উৎপন্ন 
হয়। কেমন যেন একটা জারক রসে ফেলিম্না আমাকে একদিকে যেমন 
কলম্বমুক্ত করা হইতেছে, অন্ত দিকে তেমনই একটা নৃতন ধাতু গড়িয়। 
উঠিতেছিল। নিজের ক্রমোপরিণতি দেখিয়া আমি নিজেই বিন্ময়মুগ্ধ 
হইতেছিলাম। 

চলিতে চলিতে বলিলাম, মীন্থু, এমন একটা পথে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানকার 
রাস্তাঘাট আমার কিছু জানা নেই। 

মুন্ময়ী বলিল, যদ্দি ভয় করে ফিরে যাও । যেদিন জানবে কোনো বাধা আর 
ভয় তোমার মধ্যে নেই, সেদিন আবার কাজের ভার তুলে নিয়ো! । 


৯২৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


কিন্ত ফিরে যাবার ত আর উপায় নেই। ফিরে যাবো কোথায়? নেই 
জীবনে? তাঁর চেহারা ত দেখে নেওয়৷ গেছে । অসচ্চরিত্রে আনন্দ আছে 
সন্দেহ নেই, কিন্তু ক্ষতি অনেক বেশি । ফিরে যেতে আর আমাকে বলো না, 
মুন্ময়ী। ফিরে গেলেই আমি তলিয়ে যাবো । এতদিন পরে নিজের মধ্যে 
যে-শক্তির সন্ধান পেয়েছি, সে য্দি আমাকে ওপর দিকে না! তুলতে পারে তবে 
তার প্রছণ্ড আকর্ষণে আমি অগাধ নিচে তলিয়ে যাবো । 

আমি অসহায় বোধ করিতেছিলাম তাহ! মুন্ময়ী বেশ বুঝিতে পারিল। 
হাত ধরিয়া কহিল, নিজের উপর সন্দেহ তোমার আজো ঘোচেনি। জগতের 
নীতিশাস্ত্রের বচারে যা মন্দ তা তৃমি অনেক করেছ, কিন্ত তাতে আনন্দ যে 
পাওনি তার প্রমাণ তোমার এই সন্দেহের দোলা, তুমি সুখী নও, তুমি শান্ত 
নও! তোমার মুখে চোখে অপরাধীর অন্বস্তির ছায়া, তাই যতদিন তোমার 
জীবন ততদিন এই ভূতের উপদ্রব থাকবে তোমার মনে । 

বলিলাম, কিন্তু দেশোদ্ধারের পথও ত অনিষ্দিষ্ট । 

দেশোদ্ধারের পথ ত বলিনি, বলেছি মানুষের পথ । 

মানুষের পথ কাকে বলছ? 

চৈত্রের বাতাসে ঝরাপাতা উড়িয়া চলিতোছিল। গাছের ছায়ায় ছায়ায় 
মাঠের প্রান্ত দিয়! চলিয়াছি, কপাল বাহিয়! আমাদের ঘামের ফোটা নামিয় 
আসিয়াছে । খরনুর্যরশ্মির দিকে একবার মুখ তুলিয়া মৃন্ময়ী কহিল, মানুষের 
পথ তাই ধাতে মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়। এই ধরো মানুষের নিঃস্বার্থ সেবা । 

বলিলাম, মৃন্ময়ী, কথাট। শুনতে ভালো, মানুষের সেবা । সেবার কোনো 
স্পট সংজ্ঞা বললে না। তুমি জানো ব্যক্তি বিশেষের সেবা সহজ, সমষ্টির 
সেবা! সাধারণ নয়। 

মুন্ময়ী আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, যারা দলিত, বঞ্চিত, ক্ষুধিত-__ 
সেই সব মানুষের দলকে কি তুমি খুঁজে পাওনা? 

বলিলাম, না, চোখে তাদের কখনো দেখিনি । 


১৩০ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


যদি তাদের মাঝখানে তুমি গিয়ে দাড়াও, তাদের কি তুমি আপন ক'রে 
নিতে পারবে ? রর 

তাদের মনুষ্যত্বের অবশেষ যদি কিছু থাকে হয় ত পারতেও পারি । 

আছে-মৃন্মম়ী কহিল, নিশ্চয়ই আছে। সেই পথটি জানা দরকার, যে 
সোজা গিয়ে তাদের অন্তরে ঢুকেছে । আমরা তাদের উপকার করতে যাই, 
সেবা করতে যাইনে, তাই তারা দুরে ঠেলে দেয়, আত্মীয় বলে কাছে টেনে 
নেয় না । চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাবে! তাদের কাছে। 

সং র্ নী সা 

একটি দিন মৃন্ময়ীকে না৷ দেখিলে নেই দিনটি আমার নিকট দুঃসহ হইয়! 
উদ্ভিত। আমি যেন তাহারই নিশ্বাসে নিশ্বান লইতেছিলাম, আমার কল্পনার 
আকাশ যেন তাহারই ছুইটি দৃষ্টির মধ্যে উচ্ছৃনিত হইয়া উঠিত। বাত্রি 
ভরিয়া স্বপ্নের মতো সে আমার চোখের তন্দ্রায় লাগিয়া থাকে, সমস্ত দিনমান 
ভরিয়া তাহানুই আবেশে আমি বিভোর থাকিতাম। 

পারিবারিক জীবন আমার শিথিল হইয়া আমিতেছে। যে-ঘবটি আমার 
অতি প্রিয়, যে স্থসজ্জিত ডুর়িংরুমের জন্য আমি এত অথ বায় করিয়া এত 
দেশ হইতে “কিউবিয়ো” সংগ্রহ করিয়াছি, তাহার মূলা যেন আন খুজিয়া 
পাই না। ভাবিলাম, কবে এই ঘর ভাঙিবেঃ কবে আনি মুক্তি পাইব? 
ভবিষ্যতের অতুযুগ্র আলোটা আমার চোখের উপর পড়িতেছিল, সেই আলোতে 
আমি দিশাহারা হইতেছিলাম। দূর হইতে সমুদ্রেণ গর্জন শুনিতেছি, সেখানে 
আমাকে ঝাপ দিয়। পড়িতে হইবে। অতীত জীবনের আমার সকল ইতিহাস 
মুছিয়৷ যাইতেছে, নৃতন পাতায় নূতন করিরা লাভ ক্ষতি আর সুখ দুঃখের 
কাহিনী লিখিতে হইবে। ভাবিলাম এখনও সময় আছে, মুন্মরীকে ছাড়িয়া আমি 
কোনো দূর দেশে পলাইয়া যাই, প্রান্তরে পর্বতে ঘুরিয়া বেড়াইবঃ$ আর কখনো 
তাহার কাছে আপিব না। জানি দে আমাকে বাধে নাই, আমি চিরকালের 
জন্ত মুক্তি চাহিলেও মে আমাকে বাধা দিবে লা, কিন্ত হায়, তাহা সম্ভব নয়ঃ 


১৩১ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


কেমন একটা অচ্ছ্ছে আকর্ষণে সে আমাকে টানিয়া লইতেছে । চাহিয়! 
দেখিলাম ইহা! যেন আমার জীবনের একটা অবশ্যস্ভাবী পরিণতি, আমার ভিতরে 
প্রথম হইতে কোথায় একট? ভাবপ্রব্ণ ছুর্বল মানুষ আত্মগোপন করিয়াছিল, আজ 
মুন্ময়ীর বারম্বার খোচ। খাইয়া সে বাহির হইয়। পড়িয়াছে। হিংসা, কাপটা, স্বার্থ- 
পরতা, নিয়াভিমুখীনতা, লাম্পট্য,_-দমস্ত অভিক্রম করিয়া আমার সেই ভিতরের 
মান্গষ আজ বাহিরের আলোয় আসিয়া তাহারও বাণী প্রকাশ করিতে চায় । 

সেদিন একটা নৃতন জগতে আসিম্পা উত্তীর্ণ হইলাম। কয়েকদিন হইতে 
কলিকাতায় ও শহরতলীতে একট মঞ্জুর ধর্মঘট চলিতেছিল। আজ বাইশ 
দিন হইল তাহারা কাজে যোগ দেয় নাই । শ্রমিক নেতাদের সহিত সরকার 
পক্ষ ও মালিকদের একট ষড়যন্ত্র চলিতেছিল। কিছু কিছু সর্ত পুরণ হইলে 
তবে ধর্মঘট ভাডিবে। তাহাদের বেতন বুদ্ধি ও জীবন যাত্রার সুব্যবস্থা ন। 
হইলে তাহারা কিছুতেই কাজে যোগ দিবে না। 

আমার সঙ্গে মোটর ছিল। মলিনা্ি, মুন্ময়ী আর দুইজন শ্রমিক নেতাকে 
লইয়া আমরা মেটিয়াবুরজের দিকে চলিলাম। ধমর্ঘটের চেহারা বর্ণনা কর! 
অথব1! শ্রমিক আন্দোলনের প্রচার কাধ করা আমার উদ্দেশ্য নহে । কিন্ত 
সেখানে গিয়া যাহ! দেখিলাম, পৃথিবীর আর কোথাও অনুরূপ দৃশ্ত আছে 
বলিয়! বিশ্বাস করিলাম নাঁ। মুন্ময়ীর সহিত যতবার যেখানে গিয়াছি, 
সেখানেই দেখিয়াছি নিরপরাধ মানবাত্মার উৎপীড়ন, দেখিয়াছি মানুষের 
ভিতরকার ভগবান সেখানে পঙ্থে, দুর্গন্ধে, দারিদ্র্য, অনাহারে, নিরাশ্রয়ে, 
অপমানে নতমস্তক ; দেখিলাম এই নির্বোধ, হিংআ, লোভ আর লালসাজর্জর 
ক্ষধাত শ্রমিকজগতের ভয়াবহ রূপ । 

মূলিনাদি নোংরা বস্তির ভিতর দিয়া চলিতে চলিতে বলিলেন, এরাই 
দেশের মানুষ, রাজেনবাবু। 

আলোবাযুহীন বস্তির ভিতরকার দুর্গন্ধে আর অন্ধকারে অসংখা জানোয়ার 
যেন বাসা বাধিয়া আছে । মলিনাদ্রির কথার উত্তর দ্বিলাম: না, কেবল মনে 


১৩২ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


মনে প্রতিবাদ করিলাম। বলিলাম, উহারা দেশের মানুষ নহে। লোভা 
আর বর্ধরের কুৎসিত স্বভাবের ভিতরে যে বিকার আর ধিক্কার, যে পুতিগন্ধময় 
যালিন্য, ইহারা তাহারই প্রতিরূপ। এই অসংখ্য শ্রমিকদের দুরবস্থা দেখিয়া 
ইহাদের জন্য কাঁদিব অথবা ইহাদের টানিয়! যাহারা নিচের দিকে নামাইয়াছে 
তাহাদের জন্ত চোখের জল ফেলিৰ? যাহার! সমাঙজ্পতি, শাসক, ধনতান্ত্রিক, 
লভ্যতা প্রচার লইয়। যাহাবা গর্ব করে ইহারা যেন তাহাদের সর্বাপেক্ষা কদষ 
লোভ আর লালসার সাক্ষ্য লইয্া জীবন মাপন করিতেছে । আমার নিশ্বাস 
রুদ্ধ হইয়া আসিল। 

মলিনাদি একজন নেত্রী । যাহার! ধম ঘট করিরাছে এমন শত শত লোক 
স্টাহাকে দেখিয়া ভিড করিয়া দাডাইল। কোন দল জয়গান ঘোষণা! করিল, 
কোনো! দল তাহাদের অভাব আঁহযোগের কথা জানাইতে আসিল । দীর্ঘকাল 
ধম্ঘট করিয়া তাহাদের দিন চলিতেছে মা, আশ পাশের মহল্লার চুরি-ডাকাতি 
বাড়িয়াছে ; শোভাধাত্র! করিতে বাহির হইয়া পুলিশের সহিত সংঘর্ষে অনেকেই 
আহত হইয়াছে, শ্রমিক সঙ্গা হইতে বে সাহাঘয আসিতেছে তাহা৪ পর্যাপ্ন 
নহে । দেখিতে দেখিতে দরিদ্র, ক্ষুধাতুর, উতৎ্পীডিত জনারণ্যে আমাদের বাহির 
হইবার পথ রুদ্ধ হইঘ়। গেল । আপাতত মপিনাদি ও তাহা সঙ্গী ঢুই জনকে 
উহার! বাহির হইতে দিবে না। 

সেই অন্ধকার ত্রাস্তান্ুডের ধারে আমি নতমস্থকে দাড়াইয়াছিলাম | 
আমাকে কেহ কিছু প্রশ্ন করিল না, কিন্ধ একবার উপরের কালো আকাশের 
দ্রিকে চাহিয়া আমি প্রশ্ন কবিলাম, বিপ্লব আর কতদূন ? এই যুগে আমাদের 
জীধিতকালে কি তাহা সম্ভব হইবে? পথ যাহাদের রুদ্ধ, বাচিবার অধিকার 
যাহার! পাইতেছে না, অশ্রজলে িক্ত যাহাদের অন্নের গ্রাস, নৃতগ সমাজ ও 
নবতর জীবন যাত্রাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে যাহারা বাধা পাইতেছে,_তাহাদের 
রে আগুন ধরিবার সময় কি এখনও ভর নাই? আমরা যাহারা "ত্র ও 
শিক্ষিত নলিয়া কথিত, যাহারা মধ্যবিত্ত, যাহারা পৃথিবীর অগ্রসর চিন্ু-ধারাকে 


১৩৩ 


লা শা পপ ক ৬4 পপির কতো 


ঝড়ের সঙ্কেত 


স্বাধীন কম€প্রতিভায় প্রকাশ করিতে পারিতেছি না, তাহারা কি চিরদিন 
পদানত হইয়া থাকিবে? কোথায় সেই বিপ্লব, যে-বিপ্রব এই প্রচলন ও 
অস্বাভাবিক অনিয়মের ভিত্তি চুর্ণ করিবে? কবে আসিবে সেদিন? 

আমি দাড়াইয়। দাড়াইয়া কাপিতেছিলাম। মৃন্ময়ী আমাকে চিনিত, সে 
আমার হাত ধরিয়া টানিয়া বাহিরে আনিল। মলিনার্দিকে উহার! ছাড়িবে 
না, তিনি উহাদের মাঝখানে বহিয়া গেলেন। আমরা ভিড়ের ভিতর 
দিয়! পথ কাটিয়া মাঠের ধারে আসিয়া পড়িলাম। চারিদিকে আপস-শ্যাওড়া 
ও কীাটালতার গাছ, আশে পাশে দুর্গন্ধ__-তাহাদেরই ভিতর দিয়া একটা 
সঙ্কীর্ণ পথ পশ্চিম দিকে গিয়াছে । আমরা সেই পথ ধবিলাম । 

মৃন্যয়ী কহিল, অত সহঙ্জে তোমার উত্তেজন! আসে, শরীর বোধহয় 
ভালে! নেই। 

বলিলাম, এদের তোমরা সহা করো মুনুয়ী, দম আটকায় না? 

সে কহিল, ওদের মাঝখানে থাকলেই ওরা আপন করে নেয়। 

কিন্ত আপন হওয়া যায় কি? 

সৃন্ময়ী কহিল, উচ্চশিক্ষার মনের জটিলতা বাড়িয়ে দেয়। শুদের মন 
শিক্ষার পালিশে ঢাকা নয়। ওরা আমাদের মা বলে, আমাদের সম্মানের 
জন্য ওরা বুকের রক্ত দিতে পারে, আমাদের ওপর ওদের লোভ 
থাকতো, তবে ওদের 'ধলবদ্ধ পাশব অত্যাচারে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতুম। 
আধুনিক মনম্তত্বের আবহাওয়ায় ওর! পৌছোয়নি তাই ওদের মহত্ব আর 
ছুর্বলত এখনো সতেজ রয়েছে । ওরা আমাদের আপন ক'রে নেয় সহজে, 
ছুড়ে ফেলে দেয় অনায়াসে । 

বলিলাম, ওদের ধম্ঘট করালে তোমরা, কিন্তু ওদের দায়িত্ব কি নিচ্ছ 
তোমরা? 

সৃন্ময়ী কহিল, না, ওদের সাহায্য করব, দায়িত্ব নেবো না। ওদের 
শিক্ষিত করে তোলা, স্বাধিকারবুদ্ধি জাগ্রত করা, ওদের জীবনে বড় অসস্তোষ 


১৩৪ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


জাগিয়ে দেওয়া, ' শাসনক্ষমতার দিকে ওদের মনকে প্রলুন্ধ করা--এই 
আমাদের কাজ। নিজের মূল্য ওরা যেদিন বুঝবে, নিজের দায়িত্বও সেদিন 
থেকে ওরা নেবে। 

বলিলাম, কিন্তু গণদেবতাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলার পরিণাম জানো 
ত, মুন্ময়ী? 

জানি-_বলিয়া মুশয়ী হাসিল। পথের আলোয় তাহার অধরের সেই 
বিদ্যুজাল! দেখিয়া আমি কিছু বিস্ময় বোধ করিলাম; বোধ করি সে 
আমার চোখের দোষ, নচেৎ সহসা তাহার চেহারায় একটা ধ্বংসাত্তিকা 
উয্ভীষণার চেহারা দেখিব কেন? ভাভার কল্যাণী রূপ দেখিয়াছি, দেখিয়াছি 
তাহার চোখে মুখে মধুরের ভ্দ্রাবেশ, শুনিয়াছি তাহার কণ্ঠে জগদ্ধাত্রীর 
আশীর্বাদ,কিন্তু এই পাশবতা। কখন৭ দেখি নাই। যেন তাহার মুখে 
ভাবী ভারতের সর্বনাশ। বিপ্লবের চেহারা দ্বেখিলীম। যেন রক্ততৃষাতুরা। 
গ্রতিহিংসামরী করালি কালিকার মতে। মে আমার দিকে চাহিল। বলিল, 
জানি গো জানি, মরণে ভয় পাও কেন? গণদানবের পারের তলায় 
একদিন চুর্ণ হবো আমরা মধ্যবিত্ত, আমাদের বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবে 
না। কী অদ্ভূত দেশ তুমি ভাবো দেখি? শতকরা নব্বইজন চাষী--যারা 
আমাদের প্রাণধারণের খাদ্য জোগায় তাদের অশ্নবন নেই,--আর বাকি দশজনের 
হাতে ধনসম্পৃত্তি, তারা নব্বইজনকে রেখেছে পায়ের তলায়। এ কখনো সইবে? 
কোনো দেশে সহ্‌ হয় নি। 

বলিলাম, কিন্তু তা'তে আমরাও ত ধ্বংস হয়ে যাবো। 

মুন্ময়ী বলিল, সেই আমাদের স্বপ্নি। ষে-বিপ্লব একদিন ওরা আনবে সেই 
তরক্গে আমরা তলিয়ে যাবো, সেই হবে একমাত্র আনন্দের দিন। তোমাকে 
আমাকে সেইদিনের জন্ত প্রস্থত হতে হবে। 

চলিতে চলিতে গঙ্গার ধারে আসিয়া পড়িলাম। চাহিয়া দেখিলাম গঙ্গার 
পশ্চিম প্রান্তে শুরু-চতুর্থী চন্্র হেলিয়া পড়িয়াছে। নদীর ছুই পারে দীপমালা 


১৩৫ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


জলিতেছে। বসন্ত-বাতান হু-হু করিয়৷ বহিতেছে। বলিলাম, দূরে ট্রীমারের 
জেঠি দেখা যাচ্ছে, চলো। আমরা ্রীমারে ক'রে ফিরে যাই । 

নদীর চেহার] দেখিয়া মুন্সী সব কথ! ভুলিয়া গেল, উৎসাহিত হইয়া 
কহিল, চলো, বেশ লাগবে । নৌকে। করলে না কেন? ঢেউয়ের দোলা 
লাগতো ? 

কিন্ত নৌকা পাওয়া গেল না, সুতরাং টিকেট কিনিয়! ষ্টামারের জন্য 
অপেক্ষা করিলাম। ট্রামার আপিয়া জেঠিতে লাগিলে তাহাতেই গিয়া 
চড়িলাম। 

প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। শ্রমিক আন্দোলন লইয়া! যতই বক্তৃতা করি না 
কেন, বসন্ত-বাতাসে নিরিবিলি গঙ্গার বক্ষে তরুণী সমভিব্যহারে প্রথম শ্রেণীতে 
ভ্রমণ কারবার আনন্দ ও আবাম গণতঙ্থের জন্য ত্যাগ করিতে প্রস্তত নহি। 
দেশের জন্য প্রাণ পরে দ্রিলেও চলিবে, শ্রমিকদেন্ন শাসনাধিকার পাইতে ঘণ্টা 
দুই দেরী হইলে ক্ষতি নাই এবং অগ্যকার এমন অপরূপ সন্ধ্যাটিতে যদি 
দেশের স্বরাজ ও স্বাধীনত। না পাই, তবে বিশেষ ক্ষতি মনে করিব ন।। 
আপাতত শ্রমিক নেত্রী শ্রীমতী মৃন্ময়ীকে এতই সুন্দর দেখাইতেছে যে, 
আমি একরূপ দেশের কথ! ভুলিয়া নিজের প্রাণের কথাই আরম্ত করিয়া 
দিলাম। 

বাতাস লাগিয়া সমস্ত প্রাণ জুড়াইয়া গেল। নদীর শোভা, আকাশের 
উজ্জ্বল তারকার্দি ও পরস্পরের নিবিড় সাহচধে আগাদের আগেকার 
আলোচনাট। ঘুরিয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক হইয়া উঠিল। যেন উপলব্ধি করিলাম 
আমাদের দুইজনের জীবন এই মুহূর্তটিতে পৌছিয়া কণ্টকিত হইয়া উঠিয়াছে। 
আমরা ছুইজনে--অন্তত আমি জানিয়াছিলাম আমাদের আর বিচ্ছেদ নাই, 
আমব্রা পরম্পর চিরদ্দিনের জন্য উভয়ের নিকট বাধ! পড়িয়াছি। মৃন্ময়ীর মুখের 
দিকে চাহিয়া দেখিলাম, স্বাঁযুতন্ত্রের উত্তেজনার পর সে বড় শ্রান্ত, অবসন্ন 
-গঙ্গার মধুর হাওয়ায় তাহার চোখে যেন স্ুখতন্দ্রার নেশ। লাগিতেছে। 


৯৩৬ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


তাহার সহিত আমার চোখাচোখি হইতেই সে মৃদু হাসিয়া! একান্ত নির্ভরশীল! 
বালিকার ন্তায় আরও কাছে সরিয়া আসিয়া আমার হাতের মধ্যে মাথা 
গুজিল। 

প্রথম শ্রেণীর এই দিকে বন্গিলে কোথাও হইতে দেখা যায় না। ট্রিমার 
নদীর জল কাটিয়া কাটিয়া! চলিতেছিল। আজ আমার হাতখান1 কিছুতেই 
আর সংযত হইতে চাহিল না, তাহার গল! বেড়িয়া পিঠের উপর দিয়া হাতখান! 
জড়াইয়া কহিলাম, এত, শ্রমিক নেত্রীর উপযুক্ত নয়, মুন্ময়ী ? 

ঘুমজড়ানে। কণে মুন্ময়ী কহিল, কথ! বলো না, চুপ ক'রে থাকো । 

বলিলাম, এত বড় একটা অবৈধ ব্যাপার ঘটবে মা গঙ্গার বুকের 
ওপর, আর আমি কথ। বলবো না? 

অবৈণ কোথায় হোলো ? খ্বন্ন্ধী বিন্ময় গ্রকাশ করিল । 

বিবাভের দ্বারা বে-ভালবাস সিদ্ধ নয়, তাই ত? অবৈধ । 

মুন্ময়ী সোজ। হইয়া উঠিয়া বসিল। একরূপ চাপা অস্বাভাবিক কে 
কহিল, মনে থাকে না! 

আমি উত্তর দিলাম না, কিন্ত নে পুনরায় কহিল, তুমি কাছে না 
থাকলে শক্তি আর স্বাতন্ত্য থাকে, তোমাকে দেখলে দুর্বল হই, মনট। আশ্রয় 
চাইতে থাকে 1--তাহার চোখ দুইটি ঝাপনা হইয়া আমিল। 

বণিলাঘ, মুন্সী, তূমি জানো, তুমি একান্ত একা? 

জানি। 

তোমার ছুিনে, দুর্ভাগ্যে তোমার জনসাধারণের সেবার কাজে তোমার 
পাশে আপন জন কেউ নেই, এ কথাও কি জানো? 

তাহার চোঁখে অশ্রু ফোটা জমিরা উঠিল। কহিল, জানি। তুমিও 
কি থাকবে না? 

বলিলাম, কেন থাকবো? না দিলে তুমি অধিকার, না পেলাম শাস্ধের 
সম্মতি । কোন্‌ দাবী নিয়ে তামার পাশে আমি দাড়াবে ? 


১৩৭ 


ঝড়ের সন্কেত 


মুন্ময়ী কহিল, যদি অবৈধই হয় তুমি কি সহা করবে না? তুমি ত, 
অনেক অন্তায় করেছ জীবনে । 

উত্তেজিত হ্ইয়া বলিলাম, অন্তায় আমি অনেক করেছি কিন্তু তোমার 
এই অন্ধতা কেন? যা নীতিবিরোধী, শাস্ত্র বিরোধী, সমাজবিরোধী তার 
ওপর তোমার এত মমতা! কেন, মুন্ময়ী ? 

মুন্সয়ী সোজা] হইয়া বসিল। কহিল, আমি যে স্বাধীনতা চাই--কঠিন 
নিষ্ঠর স্বাধীনতা । কৈফিয়ৎ দেবার, পেছন দিকে চাইবার, মোহ্গ্রস্ত হবার, 
সংসারের দিকে আকর্ষণ করবার-_মানুষ যেন কোথাও না থাকে । কাজের 
মধ্যে, ওদের ছুঃখের মধ্যে তলিয়ে থাকতে চাই সারা দিনরাত-_ সমস্তক্ষণ, 
সমস্ত জীবন। কেবল ক্লান্তি আর কান্নার দিনে যেন তোমায় খুঁজে পাই, 
যেন তোমার পায়ে মাথা রেখে আমি কোনো কোনো সময় নিশ্চিন্তে 
ঘুমোতে পারি । 

অভিমান করিয়া কহিলাম, কিন্তু আমাকে তখন কেন, মৃন্ময়ী ? 

তোমাকেই তখন দরকার, তুমি আমার নতুন স্থষ্টি। তোমাকে নতুন 
জীবনের ছাচে ঢেলেছি সেই আমার গৌরব। সব কাজের শেষে ষেন 
তোমারই কাছে আশ্রয় পাই । 

বলিলাম, এতে কি তুমি শাস্তি পাবে? 

মূন্ময়ী কহিল, হয়ত পাবো না, তবু জানাতে পারবে। ভগবানের কাছে 
যে স্থখের নেশা আমি ত্যাগ করেছি । আমার ভাঁইবোনেরা, আমার 
সম্তানরা-_তার1 যেন জানতে পারে আমি তাদের ছাড়া আর কারো নই, 
আমার ছুই হাত ফেন চিরদিন তাদেরই সেবার জন্য মুক্ত থাকতে পারে। 
আমাকে কি তুমি স্বধর্ম ত্যাগ করতে বলো? 

কিন্ত অনেকদিন হইতে যাহা বলিব ভাবিতেছিলাম তাহাই এইবার 
আমি প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম। বলিলাম, মুন্ময়ী, তৃমি প্বাধীন, তুমি 
সববাধাহীন--তোমার কোনো কাজে, কোনো চিন্তায় কোনো আদশে 


১৩৮ 


কড়ের সঙ্কেত 


আমি কখনো বাধা দেবো না, আপত্তি তুলবো ন!, কিন্তু, আমাকে আজ 
নিশ্চিন্ক হয়ে তোমার কাজের মাঝখানে ঝাপ দিতে দাও। আমি তোমাকে 
বিয়ে করবো, মীন্ত। 

বিয়ে !-মুন্ময়ী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। আমার একখানা হাত 
সে তখনও ধরিঘ্লাছিল, কিন্তু সেই হাত তাহার শিথিল হইয়া আসিল! 
এক স্ময় কহিল, না সে সম্ভব নয়, তুমি দুঃখ করো না । 

হয়ত আমার তেজন্থিনী জননীর কথা সে ভাবিল, ভয়ত ভাবিল, আমাদের 
পরিবারের সামাজিক প্রতিষ্ঠার কথা, হয়ত ভাবিল আনার অপেক্ষা জাতিতে 
সে ছোট। কী যে সে সহসা ভাবিল, বুঝিলাম না। আমি ব্যাকুল হইয়া 
কহিলীম, কেন সম্ভব নয় বললে না ত? 

দে সহ কে কহিল, তুমি টাকার মানষ, তুমি অগাধ সম্পত্তির 
মালিক | নিশ্চিন্ত আরাম, পরম সখ, অবাধ ভোগ আর বিলাস, অতুল এ্রধ-. 
এদের মাঝখানে গিয়ে দাভালে অপমানে যে আমার মাথা হেট হয়ে যাবে? 
দরিদ্র দুর্ভাগা! সম্ভানদল আর সর্বত্যাগী ভাইবোনদের আদর্শবাদের ভয়ে আমি 
ছুটে পালাবে স্থখের গুহাগহবরে ? ভগবান কি আমাকে ক্ষমা করবেন? এই 
পাপে কি তোমার কল্যাণ হবে? 

কিন্ত যদি সবাই তোমার সঙ্গে থাকে ? 

কেমন ক'রে? | 

বলিলাম, আমার জীবন-মরণ যার হাতে দিলুম সে আমার লামান্ত সম্পত্তির 
বিলি-ব্যবস্থা করবে না? 

মূন্মপধ়ী আমার মুখের দিকে চাহিল, কহিল, আমাকে সব তুমি দান 
করবে? 

দান কোথায়, মৃন্ময়ী ? তোমারই ত সব। 

সে উত্তর দিল না, অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। মার হাস ফাস করিয়া 
তরচ্চ কাটিতে কাটিতে উত্তর দ্রিকে চলিয়াছে। পথ আর বাকি নাই । 


১৩৯ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


নিশ্বাস ফেলিয়া এক সময় মৃন্ময়ী কহিল, ওই দবিদ্র পলীর মাঝখানে গিয়ে 
সামান্য শিক্ষকের জীবনযাপন করা, পরিশ্রমের ছারা অর্জন করা অন্নে দিন 
চালানো--পারবে তুঘি? ছুর্ধোগে, দারিদ্র, অবজ্ঞায় ক্ষুদ্র হয়ে থাকা»_ 
বলে॥ পারবে তুমি? 

কম্পিত কণ্ঠে কহিলাম, তুমি আমাকে আঁজো চিনতে পারোনি, তার চেয়েও 
বড কাজ আমি পারবো । 

মৃন্ময়ী কহিল, তুমি ত মেয়েদের কোনোদিন সম্মান দাওনি, আমার নান 
তুমি রাখবে কেমন করে? 

আমাকে তুমি নতুন জীবনের ছাচে ঢেলেছ, এখন ত আর এ-গ্রশ্ 
ওঠে না? 

কিন্তু বদি আনার এই বূপট্কু নষ্ট হয় কোনো কঠিন অন্গুখে ? 

নলিলাম, ক্ষতি মনে করবে। না, কারণ চোখ দিয়ে তোমাকে পাইনি 
মুন্ময়ী, পেয়েছি মন দিয়ে । কূপের সন্ধান আমাকে অনেকেই দিয়েছে, বড 
আদর্শের সন্ধান কেবল তোমারই কাছে পেলুম। এই গঙ্গার বুকের ওপর 
বসে বলছি,_-পবিত্র জয়ভূমির শপথ নিয়ে তোঘাকে জানাচ্ছি, আমার সব 
কিছু ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে পথের ভিথিরী ক'রে দাও তুমি-_সেই হবে 
আমার সকল অহঙ্কার আর আল্মাভিনাঁন থেকে মুক্তি! 

নিজের চোখে জল আসিরাছে অনুভব করিলাম, মুন্ময়ীর গাল বাহিয়া 
অশ্রু ঝিতেছে দেখিলাম । মে আমার শেষ কথা শুনিয়া হেট হইয়] 
আদার পায়ের ধুলা লইল। কহিল, এতদিনে জানলুম কী আমি চেয়েছিলুঘ, 
এর চেয়ে বেশি কিছু নয়, এর চেয়ে বড়কিছু নয়। আজ নিঃসক্ষোচে 
তোমার হাতে আত্মসমর্পণ করলুম। তুদি আমার স্বামী । ও 

উপরে কালবৈশাখী আকাশ ঘন হইয়া উঠিয়াছে। টাদপাল ঘাটে 
আসিয়া ষ্টীমার ধরিল। আমরা পৃথিবীকে ভূলিয়াছিলাম আজ যেন নৃত, 
জগতে আসিয়া উত্তীর্ণ হইলাম। দূর হইতে নূতন এক জীবন যে+ 


৯৪৩ 


ঝড়ের সঙ্কেত 


সামাদের হাত বাড়াইয়। ডাকিল ৷ দুইজনে নির্ষ হাসিমুখে হাত ধরাধরি 
রিয়া সেইদিকে চলিলাম। দেখিতে দেখিতে আকা ডাকিয়া বৃষ্টি 
মল। 


১৪৯